স্ত্রীকে দিয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তার ‘বিয়ের ফাঁদ’

সোনিয়া আক্তার ইভানা (৩৬)। প্রথম স্বামী থাকা অবস্থাতেই সমঝোতার দুটি ‘বিয়ে’ করেন তিনি। ১০ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন এক পুলিশ কর্মকর্তাকে। এরপর ওই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে—এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে পর পর বিয়ে করেন আরও দুজনকে। এদের একজন আইনজীবী এবং অপরজন ঢাকার ব্যবসায়ী। তবে পরের দুজনেরই এটি দ্বিতীয় সংসার হওয়ায় তারা মূলত দিনেই যেতেন ওই তরুণীর সান্নিধ্যে। এই সুযোগে রাতে এসে থাকতেন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম স্বামী। পরের দুই স্বামীরই অভিযোগ, প্রথম স্বামীর পরিকল্পনায় বিয়ের ফাঁদ পেতে স্ত্রী হাতিয়ে নিয়েছেন গাড়িসহ কয়েক কোটি টাকা। এমনকি এক স্বামীর কাছ থেকে লিখে নিয়েছেন দামি রেস্টুরেন্টের মালিকানাও।

সোনিয়া আক্তার ইভানা (৩৬) নামের এই তরুণীর প্রথম স্বামী একজন পুলিশ কর্মকর্তা: নাম জব্বারুল ইসলাম রয়েল। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ। এই সংসারে তাদের একটি ছেলে আছে। রাজধানীর বনানীতে এখন মাসে আড়াই লাখ টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ইভানা। বনানীর এ-ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ফ্লাট ৯/এ ও ৯/বি ঠিকানার ওই বাসা পাঁচ হাজার স্কয়ার ফিটের।

ইভানার পরের দুই স্বামীরই অভিযোগ, প্রথম স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে- এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি পরের বিয়ে দুটি করেছেন। এটা ছিল পরিকল্পিত। তারা অভিযোগ তুলেছেন, টাকা ও সম্পদ হাতিয়ে নিতে স্ত্রীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম স্বামী। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ জব্বারুল ইসলাম রয়েল তার স্ত্রী ইভানার আরও দুই বিয়ের কথা জেনেও চুপ ছিলেন। পরের দুই স্বামীরই অভিযোগ, পুলিশ স্বামীই ইভানাকে পরামর্শ দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে টাকা-গাড়ি-রেস্টুরেন্ট হাতিয়ে নিতে।
জানা গেছে, ইভানার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। প্রায় এক দশক আগে পুলিশ পরিদর্শক জব্বারুল ইসলাম রয়েলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর মাঝে মাঝে তিনি স্বামীর কর্মস্থল চট্টগ্রামে এসে থাকতেন। তবে বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন ঢাকার বিলাসী ফ্ল্যাটে।

ইভানার পরের দুই স্বামীর একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বনানীর একটি বারে পরিচয় হয় ইভানার সঙ্গে। এরপর একসময় গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরে ২০১৯ সালের জুন মাসে ইভানার সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ায় বিয়ে হয়।’

জহুরুলের এটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। তবে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়নি তার। এ কারণে ইভানার ঢাকার বনানীর বাসায় দিনের বেলাতেই যাতায়াত করতেন জহুরুল। সেখানে তিনি রাতে থাকতেন না। এরই মধ্যে গত ১৩ নভেম্বর রাতে ইভানাকে একাধিকবার ফোনে না পেয়ে পরদিন শনিবার (১৪ নভেম্বর) সকালে বনানীর বাসায় হাজির হন তিনি। বাসায় গিয়ে একজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ইভানাকে দেখতে পান। ওই একজনের পরিচয় জানতে চাইলে ইভানা জানান, ওনার নাম জব্বারুল ইসলাম রয়েল। তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত আছেন তিনি। এই পুলিশ কর্মকর্তাই তার প্রথম স্বামী।

ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এ সময় পুলিশ কর্মকর্তা রয়েলের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি ইভানাকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আমি জানাই, ইভানা তো আমারও স্ত্রী। কিছুদিন আগে সে আমাকে জানিয়েছে, আপনার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ইভানার সঙ্গে তার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি।’

জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ইভানাসহ ওই পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য এ সময় আমাকে হুমকি দেন।’ এ ঘটনার পর জহুরুল ইসলাম বনানীর ওই বাসা থেকে বেরিয়ে নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি ইভানাকে তালাকও দেন।

ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘ইভানা বিয়ের পর কমপক্ষে দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে দুই মাস আগে তার মালিকানাধীন পেট্রাস রেস্টুরেন্টটিও ব্ল্যাকমেইলিং করে লিখে নিয়েছে। যার দাম ৫০ লাখ টাকা। বিয়ের পর পরই ১৬ লাখ টাকা দামের গাড়ি এবং সর্বশেষ গত অক্টোবরে ৪০ লাখ টাকার আরেকটি গাড়ি নিয়েছে। এর বাইরে ক্যাশ নিয়েছে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রথমপক্ষের ছেলেকে কানাডায় পাঠানোর নাম করে ক্যামব্রিয়ানে ফাইল জমা বাবদ ২০ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়েছে। অথচ ক্যামব্রিয়ানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেখানে কোনো ফাইলই জমা দেওয়া হয়নি। সেও (ইভানা) কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি।’

জহুরুল ইসলামের আগে ইভানা বিয়ে করেছিলেন রেজাউল করিম নামের একজন আইনজীবীকে। ঘটনাচক্রে রেজাউল করিমেরও সেটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। তবে ইভানার সঙ্গে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের। রেজাউলকে ইভানা বলেছিলেন, প্রথম স্বামী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এর এক পর্যায়ে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম স্ত্রীর অজ্ঞাতেই বিয়েটি করায় ঢাকায় ইভানার নিকেতনের বাসায় (বি ব্লকের ২ নম্বর সড়কের ৪৫ নম্বর বাড়ি) মূলত দিনের বেলাতেই যাতায়াত করতেন রেজাউল করিম। তবে একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন, ওই বাসায় রাতের বেলায় আসতেন তার প্রথম স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা জব্বারুল ইসলাম রয়েল। এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে দায়িত্বরত রয়েলকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চান। কিন্তু রয়েল ঢাকায় এসে পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানালেও তার দেখা আর কখনও পাননি।

আইনজীবী রেজাউল করিম বলেন, ‘ইভানা এক বছরে সবমিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে তার কাছ থেকে সরে এসেছি এবং তালাকও দিয়েছি। ইভানার প্রতারণার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তার প্রথম স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা জব্বারুল ইসলাম। ইভানাকে দিয়ে তিনি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ পেতেছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে শুক্রবার (২০ নভেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ জব্বারুল ইসলাম রয়েলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। তবে চট্টগ্রামে পুলিশের স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি বর্তমানে ছুটিতে ঢাকায় আছেন। জব্বারুল ইসলাম রয়েল ও তার স্ত্রী ইভানার প্রতারণার ঘটনায় পুলিশ ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।