তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী অথচ ডিগ্রি, পুরস্কার ও খ্যাতি সবই ভুয়া!

তিনি তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক, তিনি বিশিষ্ট আলোচক ও ডিপেস্নাম্যাট, তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা। কিন্তু বাস্তবে ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে করা (সেশন ২০০৫-০৬) এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া তার বাকি সব পরিচয়ই ভুয়া।

এত সব ভুয়া পরিচয়ধারী চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারকে গতকাল রোববার সকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মিরপুর থেকে গ্রেফতার করে র‍্যাব ৪। পরে বিকালে রাজধানীর কাওরান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

খন্দকার আল মঈন বলেন, মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রতারণা শুরু করে ঈশিতা। করোনাকালে তিনি বিভিন্ন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঈশিতাকে গ্রেফতার করা হয় বলেও তিনি জানান।

নিজেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গবেষক, বিশিষ্ট আলোচক, ডিপেস্নাম্যাট, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পিএইচডি হোল্ডার, মানবাধিকারকর্মী এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যসহ বিভিন্ন পরিচয় দিতেন ঈশিতা। আসলে চিকিৎসা শাস্ত্রে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া তার উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই। কিন্তু নামের পাশে চিকিৎসা শাস্ত্রের সব উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ট্যাগ বসিয়ে নিয়েছেন নিজেই। মিরপুর-১ থেকে গ্রেফতারের পর তার বাসা থেকে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, ভুয়া সিল, ভুয়া সনদ, ভুয়া প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ইয়াবা, বিদেশি মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের দুটি ইউনিফর্ম, র‍্যাংক ব্যাচ উদ্ধার করে র‍্যাব।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে ঈশিতা বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও জার্নালে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, আর্টিকেল, থিসিস পেপার প্রকাশনা করেছেন বলেও দাবি করতেন ঈশিতা। তিনি ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বলেও দাবি করতেন। তবে সবই ভুয়া। এসব অনুষ্ঠানের ছবি এডিট করে নিজের ছবি বসিয়ে দিতেন তিনি।

র‍্যাব জানায়, ঈশিতা প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশ নেন। ঈশিতা বিশ্বের ৬০/৬৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন বলে দাবি করেন। তবে তিনি শুধু গিয়েছিলেন জার্মানিতে।

এসব তিনি মূলত খ্যাতি ও অর্থ আত্মসাতের জন্য করতেন। ঈশিতা করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন। অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট প্রদান করে তিনি প্রচার-প্রচারণা করেছেন।

এছাড়া ‘ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটি’ নামে তিনি একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। সংস্থাটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচারণা করা হয়েছে। এই সংস্থার ফেসবুক পেজের মাধ্যমে দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বুরুন্ডি, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ হয়েছে। এছাড়াও ওই দেশগুলোতে এই সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার, অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভুয়া অ্যাওয়ার্ড বিতরণের বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী গ্রহণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন।

গ্রেফতারকৃত ঈশিতা প্রতারণার কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর র‍্যাংক ব্যাজ ও পদ অর্জনের চেষ্টা চালান। তিনি ফিলিপাইনে পরিচালিত একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারের বিনিময়ে সামরিক বাহিনীর ন্যায় ‘বিগ্রেডিয়ার জেনারেল’ পদটি নেন বলে জানান। তবে এই সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব পায়নি র‍্যাব।

বিভিন্ন স্থানে পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন এড়াতে ‘বস’ হিসেবে গ্রেফতারকৃত শহিদুল ইসলাম দিদার ভূমিকা রাখতেন। যিনি টেলিফোন/অনলাইনে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সশরীরে উপস্থিত হয়ে গ্রেফতারকৃত ইশরাত রফিক ঈশিতার পরিচয় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতেন।

দিদার ২০১২ সালে একটি ডিপেস্নামা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপেস্নামা (ইঞ্জিনিয়ার) সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপেস্নামাও সম্পন্ন করেন। বর্তমানে একটি গার্মেন্টসে কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। তারা দু’জনই বিভিন্ন সংস্থার ভুয়া সদস্য, কর্ণধার বা দূত হিসেবে দেশে/বিদেশে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধ কার্যক্রমে যুক্ত। তাদের আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে র‍্যাব।