বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের শীর্ষে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের পদ্মার রুপালি ইলিশ পৃথিবী বিখ্যাত। বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ২০১৭ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই শীর্ষে। বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের মোট ১১টি দেশে ইলিশ মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে, যার সব ক’টি দেশই এশিয়ায় অবস্থিত। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড,পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাহরাইন এবং কুয়েত। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্লড ফিশ’-এর পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে কেবল বাংলাদেশেই প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে। বাকি সব ক’টি দেশেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। ইলিশের উৎপাদনে বাংলাদেশের পরই দ্বিতীয় স্থানে ভারত। দেশটিতে পাঁচ বছর আগেও বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হতো। চলতি বছর তাদের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছে। ভারতের পর তৃতীয় অবস্থানে থাকা মিয়ানমারে উৎপাদন হয়েছে ৩ শতাংশের মতো। পাকিস্তান, কুয়েত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, ইরান ও ইরাকে উৎপাদন হয়েছে বাকি ১ শতাংশ ইলিশ।

বিশ্বেজুড়ে বাঙালী রসনার বিপুল চাহিদা মেটানোর পরেও বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন কেন এবং কীভাবে বাড়ছে তা নিয়ে কৌতূহলী হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, ইলিশ সারা বছরই কমবেশি ডিম ছাড়ে। তবে প্রধান প্রজনন মৌসুম হচ্ছে আশ্বিন (অক্টোবর) মাস। প্রাথমিক গবেষণা ভিত্তিতে ইতিপূর্বে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে ও পরের ১০ দিন, ১১ দিন ও ১৫ দিন মা ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা হলেও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা ও তথ্যের ভিত্তিতে তা ২২ দিন অর্থাৎ
আশ্বিনের বড় পূণির্মার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) করা হয়েছে – যা ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, একটি ইলিশ ৩ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠা পানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তী সময়ে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫) সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠা পানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।

বছরের একটা দীর্ঘ সময়ে জাটকাসহ ইলিশ আহরণে থাকছে নিষেধাজ্ঞা। তার পরেও সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত ১০ বছরে উৎপাদনের এ হার তিনগুণেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ উৎপাদন বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে সরকারের কঠোর নজরদারি, তদারকি ও নানামুখী বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়ন। বেসরকারী যথাযথ উদ্যোগও এক্ষেত্রে সফল ভূমিকা রেখেছে। আসলে বাংলাদেশ বিভিন্ন নদীতে ইলিশের ডিম পাড়ার জায়গা এবং বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে উপযুক্ত সময়ে তার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পেরেছে। এসব জায়গায় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ ধরা নিষেধ। এ ছাড়া বছরে আট মাস ছোট ইলিশ বা জাটকা ধরা নিষেধ। এটা কেবল সরকারী কাগুজে ঘোষণা নয়, বাংলাদেশে ছোট ইলিশ ধরা আইন করে নিষেধ করা হয়েছে। এ আট মাস জাটকা ধরার ওপর নজরদারি চালাতে সরকার কোস্টগার্ডকে নিয়োজিত করেছে। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরলে বিপুল জরিমানা, এমন কী কারাবাসও হতে হয় মৎস্যজীবীদের। এই কয়েক মাসের জন্য মৎস্যজীবীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে সরকার দেশের ২ লাখ ২৪ হাজার মৎস্যজীবীকে পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছে। কর্মহীন মৎস্যজীবীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় ত্রাণ দেয়া হয়। এমন বেশ কিছু উদ্যোগের কারণেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। এ সংক্রান্ত সরকারী পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ৯ বছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ।

সারাদেশের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বরিশাল বিভাগে ব্যাপক হারে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে গত ৯ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১১০ শতাংশ। একই ভাবে পটুয়াখালী জেলাতেও ইলিশ আহরণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানান হয়েছে, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এ জেলায় ইলিশ আহরণ করা হয় ১৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে পটুয়াখালী জেলায় ইলিশের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে।
সরকারের নজরদারির কারণে যেমনি ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। তেমনি আকারেও ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদিও ইলিশের মৌসুমে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নদীতে ইলিশ আসতে একটু দেরি হয়েছে। পটুয়াখালী অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা গেলে নিঃসন্দেহে পটুয়াখালী অঞ্চল ইলিশে আরও সমৃদ্ধ হবে।