ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণের হার, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ

বাংলাদেশে আবারও বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণ হার ঊর্ধ্বমুখী। আক্রান্তের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ। মাস্ক ছাড়াই অফিস, আদালত, বাজার, গণপরিবহনে চলাফেরা করছে মানুষ। সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই নেই। দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক বছর পর সংক্রমণ পরিস্থিতির নতুন মাত্রায় উদ্বেগ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, নাগরিকদের নিজেদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করতে হবে। একজন সচেতন নাগরিকের মতো দায়িত্ব পালন করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্দেশনা জারি করেছে প্রশাসন। শুধু নির্দেশনা দিলে হবে না, সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এ জন্য মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে হবে, হাত ধুতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সুস্থ থাকতে চাইলে এগুলো অবশ্যই মানতে হবে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশীদ আলম এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। সেই সঙ্গে এ দফতরের আরও বেশ কয়েকজন কর্মীর করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৬৮ জন, নমুনা টেস্ট করা হয়েছে ১৯ হাজার ৯০০ জনের। সংক্রমণের হার ৯ দশমিক ৩৯। গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৬ জন। দেশে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৬ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৮ হাজার ৬৬৮ জন। গতকাল সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৬৫০ জন, আইসিইউতে রোগী ভর্তি আছেন ৩০১ জন। সারা দেশে আইসিইউ ফাঁকা আছে ২৬২টি। তবে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। জটিল রোগী বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউ শয্যা ফাঁকা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে।

করোনা সংক্রমণের হার হঠাৎ করে ঊর্ধ্বমুখী হলেও মানুষের মধ্যে তেমন সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। গতকাল বিমানবন্দর রেলস্টেশনে দেখা যায়, সামাজিক দূরত্ব না মেনে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কমলাপুর যেতে গাদাগাদি করে তারা ট্রেনে উঠছে। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মুখে মাস্ক। অধিকাংশের মাস্ক থুঁতনিতে। অনেকে কোমরে চাবির রিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছেন মাস্ক। হাত না ধুয়ে চলছে হালকা নাস্তা খাওয়া।

বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনে রাজশাহী থেকে এসেছেন খলিলুর রহমান। বিমানবন্দর স্টেশনে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় বৃদ্ধ মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ট্রেনে মাকে নিয়ে আসলাম। আমরা একবারের জন্যও মাস্ক খুলিনি, পানি পর্যন্ত খাইনি। কিন্তু স্টেশনে নেমে দেখছি অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। আগে যাওয়ার দৌড়ে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেন থেকে নামছে, বাইরের গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মায়ের বয়স হয়েছে, তার পর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আছে। আমরা সচেতন আছি। কিন্তু আশপাশের মানুষ সচেতন না হলে আমাদের মা-বাবাকে কীভাবে বাঁচাব?’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন বয়স্করা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য রোগ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২৬ জনের মধ্যে ১৩ জনই ষাটোর্ধ্ব। গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রথম তিন রোগী শনাক্তের ঠিক ১০ দিন পর গত বছর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশফেরত স্বজনের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন পুরুষ এবং তার বয়স ছিল ৭০ বছরের বেশি।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯২ শতাংশই মারা গেছেন আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ১৪ দিনের মধ্যে। আর ২৮ দিনের মধ্যে মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ৭৬ শতাংশ ও নারী ২৪ শতাংশ। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) ‘কভিড-১৯ রোগীদের পরিণতির সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিসমূহ নিরূপণ’ শিরোনামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের সংক্রমিত হয়ে প্রথম ১৪ দিনের মধ্যে মৃত্যুহার ২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ১৫ দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। তাদের মধ্যে ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশের এক বা একাধিক অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী হলেও রাজধানীর মতো সারা দেশে নেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই।

চট্টগ্রামের প্রতিবেদক জানান, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে জেলা প্রশাসনের তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। গতকাল বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক, আশরাফুল আলম ও গালিব চৌধুরী এ অভিযান চালান। এ সময় তারা বিনামূল্যে মাস্কও বিতরণ করেছেন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রামে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছুটির দিনে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে মাস্ক বিতরণ করেছি এবং মাস্ক না থাকার কারণে ৩০ জনকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে। নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশালে মাস্ক না পরায় ১৫ জনকে অর্থদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসনের পৃথক দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ অভিযান চালায়। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কার্যকর করতে বরিশালে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১৫ জনকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু এর ছিটেফোঁটা চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে নেই। এতে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের ঢিলেঢালার সুযোগে সাধারণ মানুষের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব। সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ‘সরকার করোনা প্রতিরোধে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিকভাবে মেনে চললে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা আমাদের জন্য সহজ হবে।’
: বিডি প্রতিদিন

Scroll to Top