গুরুতর আহত মেজর সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল পুলিশ!

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁর (সিনহার) অস্ত্রের লাইসেন্স নীলিমা রিসোর্টে তাঁর কক্ষে রয়েছে। পরে সেই কক্ষ থেকে দেশি–বিদেশি মদ, এক পুরিয়া গাঁজাসহ শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করা হয়।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথের নামে রামু থানায় করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার এজাহারে এ কথা বলেছে পুলিশ।

অথচ পুলিশই জানিয়েছিল, ‘চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তাঁর কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালান। এতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন। তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, গুরুতর আহত মেজর (অব.) সিনহাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করল কখন এবং তিনি এত প্রশ্নের জবাবই–বা দিলেন কীভাবে?

তা ছাড়া টেকনাফ থানায় দায়ের হওয়া মামলা, নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌসের ফৌজদারি দরখাস্ত কিংবা পুলিশের বক্তব্যে কোথাও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিনহাকে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য ছিল না।

তারপরও রামু থানায় করা মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক সিনহা মো. রাশেদ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁর (সিনহার) অস্ত্রের লাইসেন্স নীলিমা রিসোর্টে তাঁর কক্ষে রয়েছে। পরে সেই কক্ষ থেকে দেশি–বিদেশি মদ, এক পুরিয়া গাঁজাসহ শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রামু থানার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় উপপরিদশর্ক (এসআই) শফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ৩১ জুলাই রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান ও সাহেতুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে আটক করার সময় সিনহা নিজের কাছে থাকা পিস্তল দিয়ে চেকপোস্টে কর্তব্যরত পুলিশকে গুলি করতে উদ্যত হন। সে সময় ফাঁড়ির ইনচার্জ (লিয়াকত আলী) জানমাল রক্ষার্থে গুলি ছোড়েন।

এতে সিনহা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। এরপর আহত সিনহা ও তাঁর সঙ্গীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সিনহা জানান, নীলিমা রিসোর্টে তাঁর ভাড়া করা কক্ষে অস্ত্রের লাইসেন্স আছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে এক পুরিয়া গাঁজা ও দেশি–বিদেশি মদ উদ্ধার করে এবং শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করে।

টেকনাফ থানায় নন্দদুলাল রক্ষিত যে মামলা করেছেন, সেখানে সিনহাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো কথা উল্লেখ নেই। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‍‍চালকের আসনে থাকা ব্যক্তি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। আইসি স্যার (লিয়াকত আলী) তাঁকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে দাঁড়াতে বলেন এবং বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। …কিছুক্ষণ পর মেজর পরিচয় দানকারী ব্যক্তি তর্ক করে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। হঠাৎ কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন।

এজাহারে বলা হয়, ওই সময় লিয়াকত আলী চারটি গুলি ছোড়েন। সিনহার অস্ত্র নিজের হেফাজতে নেন। সিনহার সঙ্গে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে নাম–ঠিকানা নেন এবং তাৎক্ষণিক গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

চরিত্র হননের চেষ্টা
হত্যাকাণ্ডের পর নীলিমা রিসোর্টে যায় রামু থানার পুলিশ। মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি পুলিশ এজাহারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে শিপ্রা দেবনাথের চরিত্র হননের মতো বাক্য একাধিকবার লিখেছে। এমনকি আদালতে শিপ্রাকে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেলহাজতে রাখার যে আরজি দিয়েছে পুলিশ, সেখানেও অবমাননাকর বাক্যগুলো জুড়ে দেয়।

রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জানান, তাঁরা শিপ্রাকে রিমান্ডে চান। অন্যদিকে, শিপ্রার বাবা নবকুমার দেবনাথ বলেন, তাঁর মেয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দিয়েছে পুলিশ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির জানান, তাঁরা এই মামলায় শিপ্রাকে আইনি সহযোগিতা দেবেন। মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেতে তাঁদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
:প্রথম আলো