‘ধর্ম’ নিয়ে সংশয়, মর্গে কিশোরীর লাশ

পুলিশের দায়িত্বে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গত এক সপ্তাহ ধরে একটি কিশোরী মেয়ের মরদেহ রাখা আছে। মেয়েটির বাবা-মা জাতিগতভাবে চাকমা এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও মেয়েটির স্বামীর পরিবার দাবি করছে,বিয়ের সময় মেয়েটি ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়েছিল।

আর এখন দুই পক্ষই মেয়েটির লাশের মালিকানা দাবি করে আবেদন করেছেন আদালতে।সেই পটভূমিতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃতের ‘ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত’ হয়ে সেই মোতাবেক র‍্যাবকে মরদেহ সৎকার করার নির্দেশ দিয়েছে কক্সবাজারের একটি আদালত।

গত ১০ ডিসেম্বর লাকিং মে চাকমা নামে ওই কিশোরীর মৃত্যু হওয়ার পর থেকে লাশের মালিকানা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব শুরু হলেও মূল ঘটনার সূত্রপাত এ বছরের জানুয়ারি থেকে।

অপহরণের অভিযোগ ও পিবিআইয়ের তদন্ত : টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের লালা অং চাকমার মেয়ে লাকিং মে চাকমা স্থানীয় একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। এ বছর জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ সন্ধ্যায় তাকে কয়েকজন অপহরণ করে বলে সেসময় অভিযোগ তোলেন মেয়েটির বাবা লালা অং। ওই সময় টেকনাফ মডেল থানায় মামলা করার চেষ্টা করলেও সেসময় পুলিশের কাছ থেকে আশানুরূপ সহায়তা না পেয়ে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তিনি মামলা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনজন আসামির নাম উল্লেখ করে এবং আরো কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি রেখে লালা অং বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক ওই অপহরণের ঘটনার তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, পিবিআই’এর কাছে হস্তান্তর করেন। পিবিআই অগাস্ট মাসে এ বিষয়ে তদন্ত শেষে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় যে বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে সেসময় মেয়েটি ‘নিজে থেকেই অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়’ এবং যাদের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের ‘অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি’।

পিবিআইয়ের ওই তদন্ত প্রতিবেদনের সাথেই অন্তত তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য সংযুক্ত করা ছিল। যারা জবানবন্দী দিয়েছেন তারা বলেন, ৫ জানুয়ারি লাকিং মে চাকমাকে তার ঘর থেকে কয়েকজন জোরপূর্বক ধরে নিয়ে সিএনজিতে করে পালিয়ে যাচ্ছে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন।অগাস্ট মাসে এই প্রতিবেদন যখন দেয়া হয়, তখনও লাকিং মে’র বাবা লালা অং তার মেয়ের কোনো খোঁজখবর জানতেন না।

লালা অং প্রথমবার তার মেয়ের খোঁজ পান নিখোঁজ হওয়ার ১১ মাসেরও বেশি সময়ের পর। ১০ ডিসেম্বর তিনি একটি ফোন পান কক্সবাজার সদর থানার উপপরিদর্শক আবদুল হালিমের কাছ থেকে। আবদুল হালিমের কাছ থেকে লালা অং জানতে পারেন যে তার মেয়ে মারা গেছে।

কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ লালা অং পান, যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় যে মেয়ের মরদেহ তিনি নিতে পারবেন না। সেসময় তিনি জানতে পারেন যে তার মেয়ে ধর্মান্তর করে বিয়ে করেছে এবং তার স্বামীর পরিবার লাশ নিজেদের হেফাজতে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।

লালা অং বলেন, তারা আমার ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে শুরুতে অপহরণ করেছে, তাকে ধর্মান্তরিত করেছে, এখন হত্যা করেছে। এখন তার লাশটা পর্যন্ত আমাকে নিতে দিচ্ছে না।”

এ ঘটনার পর ১৫ ডিসেম্বর লালা অং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি আবেদন করেন এবং অভিযোগ তোলেন যে তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। তার অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত পুনরায় ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেন র‍্যাবের কাছে।

মেয়েটির স্বামীর পরিবারের বক্তব্য কী?
লালা অংয়ের ভাষ্য অনুযায়ী যদি তার মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে থাকে, তাহলে তার বিয়ে করা বা ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ার আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভুক্তভোগী লাকিং মে চাকমার স্বামীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে লাশের মালিকানা দাবি করে আদালতে আবেদন করার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়।

তবে জানুয়ারি মাসে ভুক্তভোগীর বাবা মামলায় যে তিনজনের নাম উল্লেখ করেছিলেন, মেয়েটির স্বামী তাদের মধ্যে কেউ নন। ভুক্তভোগীর স্বামীর বড় ভাই জানান, তার ছোটভাইয়ের সাথে লাকিং মে’র বিয়ে হয়েছে, এই খবর তিনি বিয়ের পরে জানতে পারেন।

তিনি জানান, এ বছরের শুরুর দিকে কুমিল্লায় তাদের বিয়ে হয়। সেসময় মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে বলেও আমরা জানতে পারি।’

তবে এ বছরের শুরুতে তার ছোট ভাইয়ের সাথে লাকিং মে’র বিয়ে হওয়ার কথা বললেও কীভাবে এবং কবে তাদের পরিচয় বা কীভাবে তাদের বিয়ে হয়েছে এসব সম্পর্কে বিস্তারিত তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি বা পরিষ্কার করে কিছু বলেননি।

গত ১০ ডিসেম্বর সামান্য পারিবারিক কলহের জের ধরে লাকিং মে বিষ পান করে বলে জানান তিনি। পরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে লাকিং মে’কে তিনি নিয়ে যান।

তিনি জানান, ‘তার সুরতহাল করার পর আমরা জানতে পারি লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে না, কারণ তার বাবাও লাশের জন্য আবেদন করেছেন।”

তিনি জানান, সম্প্রতি লাকিং মে ও তার ছোট ভাইয়ের একটি সন্তান হয়েছে, যার বয়স প্রায় তিন সপ্তাহ।

পুলিশ কী বলছে?
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে লাকিং মে’র লাশ আসার পর থেকে এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন সদর থানার এসআই আবদুল হালিম। তিনি জানান, দুই পক্ষই ভুক্তভোগীর ধর্মীয় পরিচয়ের প্রমাণপত্র দাখিল করেছেন তার কাছে।

আবদুল হালিম বলেন, মেয়েটির বাবা তার জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দিয়েছেন, যা অনুযায়ী মেয়েটির বয়স ১৫ এর বেশি নয়। আবার তার স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকেও একটি এফিডেভিট করে বিয়ের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে মেয়েটির বয়স বোঝা না গেলেও প্রমাণিত হয় যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।’

আবদুল হালিম জানান, প্রাথমিকভাবে মরদেহের শরীরে কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন ছিল না।

লাকিং মে চাকমার মরদেহের সৎকার এখন কোন ধর্মের রীতি অনুযায়ী হবে, তা নির্ভর করছে র‍্যাবের তদন্তের ফলাফলের ওপর।