সবাইকেই কেন বিসিএস দিতে হবে?

মো. আদনান আরিফ সালিম
বলতে আক্ষেপ নেই, সম্প্রতি প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনের দৃশ্য অনেকটা এমন— ‘পুবাকাশে সবে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। আশপাশের এলাকা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠতে তখনো ঢের দেরি। শুধু দু-একটি চায়ের দোকান সবে সচল হয়েছে। আগের রাতের বাসি পাউরুটির পলিথিন আর বিস্কুটের প্যাকেটগুলো সাজিয়ে কেটলিতে টগবগ করে পানি ফুটাচ্ছে ব্যস্ত দোকানি। সে জানে আর বেশিক্ষণ লাগবে না চারপাশ থেকে পড়ুয়ার দল এসে জুটবে। বুভুক্ষ রাত্রির অনাহার, দুর্নিবার দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চিতের বোঝা নিশ্চিত করে কিছু গাইডবইয়ের পাতায় ছড়িয়ে নিতে আসবে তারা। সহজ বাংলায় বলতে গেলে এরা সেই পাঠক, যারা ক্লাসের পাঠাভ্যাস পায়ে ঠেলে বিসিএস দিতে চায়, হতে চায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবক, নামান্তরে সমাজের তথা বিয়ের বাজারের একচ্ছত্র অধিপতি। এক হাতে কাপভর্তি লিকার, অন্য হাতে জ্বলন্ত চারমিনার, কিছুক্ষণ চলবে হতাশার আলোচনা, তারপর সরে গিয়ে তারা জায়গা করে দেবে আরেক দলকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় পাঠাগার থেকে সংশপ্তক সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারটির দূরত্ব কতদূর, কিংবা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। দূরত্ব কিংবা পাঠদানের গণ্ডি যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কিংবা পঠিত বিষয়ের নামে যা-ই লেখা থাক, সবার অভীষ্ট এখন এক। তারা পড়ছে চাকরির বাজার দখলের জন্য, তাদের এ সর্বগ্রাসী প্রচেষ্টা বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে প্রমাণের জন্য। সেই সাতসকালে লাইব্রেরিতে ভালো একটা সিট দখলের জন্য তারা পিঁপড়ার সারির মতো দীর্ঘপরিসরে বিছিয়ে রাখে তাদের বইয়ের ব্যাগ, খাতা কিংবা অন্যকিছু। তারপর কেউ কেউ সরাসরি দাঁড়িয়ে থাকে সারিবদ্ধ হয়ে। সকালের এক কাপ চা আর দু-একটা বিস্কুট-পাউরুটির বাইরে মধ্যাহ্নভোজের সুযোগও হয় না অনেকের। জীবন কিংবা সমাজ সংস্কৃতি এসব চুলোয় যাক, তারা যে বিষয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা রাখে, সেই বিষয়ের সাধারণ পাঠেও তাদের আগ্রহ থাকে না। তারা জানে নষ্ট সিস্টেমের সীমিত লেখাপড়া আর সাজেশানের সুযোগে বছর কিংবা সেমিস্টারান্তের পরীক্ষায় তারা কোনোক্রমে পার হয়ে যাবে স্নাতকের বৈতরণী। এরপর তাদের ধ্যান, জ্ঞান আর প্রেম তথা জীবনের নামান্তর একটাই ! বিসিএস! বিসিএস! বিসিএস!

যদি প্রশ্ন করা হয়, সবাইকেই কেন বিসিএস দিতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশির ভাগ মানুষ একটা প্রশ্নের মাধ্যমে বল ঠেলে দেবেন আপনার কোটেই। তিনি বলবেন, ‘বিসিএস বাদে আর কী করার আছে।’ সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী তো বটেই আমাদের অভিভাবকদের কেউ এই ‘আর কী’-এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন না। অনেক কষ্টের হলেও সত্য, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার নিম্নমান আমাদের ঠেলে দিয়েছে এক নষ্ট ভবিষ্যতের দিকে। ভালো শিক্ষক না পেলে, সেখান থেকে সুশিক্ষা সম্ভব না— এটা জানার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এ কারণেই দেশের সামনের সারির প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেন না।

কারণ তাদের সবার সামনে স্পষ্ট, সেখানে উচ্চশিক্ষার পথ কতটা অমসৃণ করে তোলা হচ্ছে দিনের পর দিন। সবকিছু ধীরে ধীরে নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়ার যে ভ্রষ্ট সংস্কৃতি, সেখানে প্রথম শিকার বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এখানে পরিবার, আঞ্চলিকতা ধর্ম, রাজনীতি, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য হয়ে ওঠায় নির্বাসনে গেছে সুশিক্ষা। এ উচ্চশিক্ষা নামের ফাঁদে পড়ে ত্রাহি মধুসূদন আর্তনাদ করতে থাকা শিক্ষার্থীরা তাই এক অর্থে বিসিএস নামক পরীক্ষার ফলের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে বাধ্য। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সবকিছুর বিনিময়ে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ছে হাতে গোনা কয়েকজনের। এর বাইরে বাকিদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ গিয়ে আছড়ে পড়ছে সুদীর্ঘ বেকারত্বের অন্ধকূপে।

ক্লাসের লেখাপড়া ফেলে দিনের পর দিন গাইড মুখস্থ করতে থাকা শিক্ষার্থীরা বাস্তবে এক ধরনের বুদ্ধবন্ধ্যত্বের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের জীবনের গতিপথ হয়ে যায় অনেকটাই একমুখী। ফলে কোনোভাবে বিসিএসে ব্যর্থ হলে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না তাদের। এ ধরনের করুণ পরিণতির শিকড়টা আবার অনেক গহিনে গ্রোথিত, বাস্তবে সর্বনাশের সেই শৈশব থেকেই। সন্তান তার প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাচ্ছে কি পাচ্ছে না; সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে অভিভাবকের দৃষ্টি থাকে এখন সার্টিফিকেটে। তারা সবকিছুর বিনিময়ে হলেও চাইছেন তার সন্তান অন্তত নামকাওয়াস্তে এ প্লাস পাক। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক দুর্মর সরলরৈখিকতা-নির্ভর, সেখানে ফিরে আসার রাস্তা খোলা নেই। অর্থাৎ এই ভ্রষ্ট সিস্টেমের বলি হয়ে একজন ভালো ছাত্রই আজীবন ভালো থাকবে, সে চাইলে খেয়ালখুশি নষ্টদের দলে যোগ দিয়ে নিজের জীবন শেষ করতে পারবে। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল বিচারে একসময়ের খারাপ শিক্ষার্থী সে আর কখনই মূলধারার লেখাপড়ায় নিজের স্থান করে নিতে পারবে না। অর্থাৎ পিএসসি ভালো করলে তবেই অপেক্ষাকৃত উন্নত স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হবে তার, জেএসসির ওপর নির্ভর করবে তার এসএসসি। আর এসএসসিতে ভালো না করলে এইচএসসিতে ভালো করেও লাভ নেই। যেহেতু এই দুই পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করেই কাঠামো দাঁড় করিয়ে দেয়া যায় কে কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে, আর কে কে পারবে না। এমনকি এ ফলাফল পরবর্তীকালের চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রেও অনেকটা কুমিরের বাচ্চা বের করে দেখানোর মতো দেখা হয়। এক অর্থে, এ ফলাফলের দুষ্টচক্রে একবার ফেঁসে গেলে মৃত্যুর আগে আর নিস্তার নেই।

শিক্ষকতা পেশায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় পাতায় কাজ করেছি বেশ কয়েক বছর। সেখানে ওই পাতার সম্পাদকের পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদকের সাধারণ প্রশ্ন ছিল একটিই— ‘বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম থেকে কেন কাঙ্ক্ষিত মানের লেখক হয়ে উঠতে পারছে না, আমরা গত এক দশকে লেখকদের যে তালিকা সামনে রেখে পত্রিকার এক একটা বিশেষ আয়োজন বের করছি, সেটা এতগুলো বছর পেরিয়ে কেন দীর্ঘ হচ্ছে না।’ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি খুব সম্প্রতি। আর সেখানে খেয়াল করলাম, আশৈশব মুখস্থবিদ্যানির্ভর কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কুরে খাচ্ছে। আমরা নিজের মতো করে কিছু করার সাহসটাই যেখানে হারিয়ে ফেলছি, সেখানে লেখালেখির মতো সৃষ্টিশীল কাজ অনেক দূরের পথ। আর এই মুখস্থ বিদ্যার অভ্যাস থেকে বের হওয়ার সুযোগ যেমন থাকছে, তাই বিসিএসের উপযুক্ত বিকল্পও খুঁজে পাচ্ছে না প্রজন্ম। পরীক্ষার হলে ডিউটি দিতে গিয়ে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ প্রশ্ন একটু আনকমন হলে বৈষয়িক জ্ঞান থাকার পরেও নিজের মতো করে উত্তর লেখার সাহস করছে না।

মুখস্থবিদ্যানির্ভর কথিত ভর্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ীরা পা রাখছেন নানা ক্যাম্পাসে, যেখানে গিয়ে তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে বড় ভাই-আপুদের করে রাখা শতচ্ছিন্ন নোটের ওপর। এই মুখস্থবিদ্যায় কেউ কেউ পার পেয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটে না। সে জানতেই পারে না তার মধ্যে কত সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে ছিল। ফলে নানা ধাঁচের কোটায় জর্জরিত বিসিএসের অন্ধকূপে পা দিচ্ছে তাদের অনেকেই। লজ্জার বিষয় হলেও সত্য, অনেক কথিত ভালো শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত যারা শিক্ষক হয়েছেন, নোট মুখস্থ করায় তাদের নাম সুবিদিত। এই মুখস্ত বিদ্যার বিরুদ্ধে যারা থাকে, তাদের কেউ কেউ আবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়েও ভালো ছাত্র হতে পারে না। পরে তারা শিক্ষক হয়েও সবার শত্রু হিসেবে বিবেচিত। এ ধরনের ঘটনাগুলো পৌনঃপুনিক অরাজকতায় পুষ্ট হয়ে দিনের পর দিন বিস্তার লাভ করছে বিসিএস আসক্তির বিষবৃক্ষ। এ সমস্যা এখন জাতির ভবিষ্যেক যেমন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি একটা নষ্ট ভ্রষ্ট প্রজন্মের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে খুব কাছে থেকে। কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর থেকে উত্তরণের জন্য সবার আগে চেষ্টা করতে হবে কর্মমুখী ও জীবনধর্মী শিক্ষাকে প্রণোদিত করার জন্য।

বিসিএসের মুখস্থবিদ্যা কিংবা চাকরির জন্য হতাশা দূর করতে সবার আগে জন্মের পর পর মা-বাবাকে তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। সন্তানকে সব পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেতেই হবে কিংবা সমাজে মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের ছেলেমেয়েকে বিশেষ স্কুল কিংবা কলেজে ভর্তি করতেই হবে, এমন দুষ্টচিন্তা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে তাদের। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উচিত মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাকে নিরুত্সাহিত করে অপেক্ষাকৃত কর্মমুখী ও জীবনধর্মী শিক্ষার দিকে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের নামে চলতে থাকা ব্যতিক্রমী ধ্বংসাত্মক চিন্তা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। অন্তত যে পদ্ধতি শিক্ষকরাই এখনো বুঝে উঠতে অক্ষম, স্রোতে গা ভাসিয়ে আহম্মকের মতো শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় আমরা ভালো ফলাফলের পেছনে দৌঁড়াব না, এমন বলার সুযোগ নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, এমন উপায়ে ভালো রেজাল্ট আমরা না করি, যার ভার বহনের সক্ষমতাই আমাদের নেই। এজন্যই শিক্ষার ভিত্তি মজবুতকরণের উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে, তারপর যাচাই করে দেখতে হবে সক্ষমতা। না হলে মুখস্থবিদ্যা কিংবা বই দেখে তথা নকল করে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার বিশেষ পার্থক্য থাকবে না। ফলাফলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিসিএসনির্ভরতা আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটাও বাড়বে তখন। আর এজন্যই প্রচলিত স্রোতে গড্ডলিকা প্রবাহের বাইরে গিয়ে কেউ যদি বিসিএসের বিপরীতে কিছু ভাবতে চায়, সেক্ষেত্রে বৈষয়িক পাঠে মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই। যদি কেউ এটা করতে পারে, সে বিজয়ীর হাসি নিয়ে বলতে পারবে ‘বিসিএস বিনে ভবিষ্যৎ নাই, এ কথার ভিত্তি নাই’।

লেখক: ইতিহাসের শিক্ষক, বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/সাদ