পাকিস্তান যদি পাশে থাকে…

পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্পর্কে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘সম্পর্ক ছিন্ন করব কেন! সম্পর্কও থাকবে ঝগড়াও হবে।’ গ্রাম্য এক প্রবাদ আছে ‘রাখিলে মারিতে পারে যখনও তখন।’ বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আসার পথে রয়েছে।

মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা কোনো রোহিঙ্গা রাখবে না মিয়ানমারে। জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে রাহিঙ্গাদের উপর নির্মম ও পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি তাদের গ্রামগুলো এবং ফসলি জমি এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে যাতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থী আর কোনোদিন সেখানে ফিরতে না পারে।

১৫০ খৃস্টাব্দে সাইমন কোখবা (Simon bar Kokhba) পরাজয়ের পর রোমানেরা ইহুদী জাতিকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে দিয়েছিলো ফিলিস্তিন থেকে। ১৭৯৮ বছর বিশ্বের বহু জায়গা ঘুরে বহু লাঞ্চনা ভোগ করে অবশেষে ১৯৪৮ সালে তারা ফিলিস্তিনে ফিরে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু হিটলারই জার্মানীতে বসবাসরত ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলো। রোহিঙ্গা জাতিও একবিংশ শতাব্দীতে আজ ইহুদী জাতির মতো ভাগ্য বরণ করল।

গত ৭০ বছরে আমার মনে হয় বার্মিজদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে নৌপথে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সলিল সমাধি হয়েছে- বঙ্গোপসাগরে আর মার্তাবান উপসাগরে। এখন রোহিঙ্গা রয়েছে সৌদি আরবে, পাকিস্তানে, মালেশিয়ায় আর বাংলাদেশে। ভারতে আর চীনেও কিছু রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত বলেছে রোহিঙ্গারা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ভারত রোহিঙ্গা বিতাড়িত করে দেবে।

গত ৮ই সেপ্টেম্বর ভারত কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। ধীরে ধীরে সব রোহিঙ্গাকে সম্ভবত ভারত পুশ ব্যাক করে দেবে। বিএসএফ এর এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন তারা রোহিঙ্গা বিতাড়নের জন্য মরিচের গুড়া ছিটানো ও স্ট্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করছে। মুসলমান দেশ ছাড়া কেউই রোহিঙ্গাকে জায়গা দেবে না। জাতিত্ব মিছে নয়। যতই অসম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টা করুন না কেন পরিবেশ পরিস্থিতি অসম্প্রদায়িক থাকতে দেয় না।

পাকিস্তানে নিয়োজিত বাংলাদেশের হাই কমিশনার গত ১০ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেন। পাকিস্তানের ‘মুসলিম উম্মাহ’ প্রীতি রয়েছে। হয়তোবা তারা আন্তর্জাতিক বলয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কিছু কাজও করতে পারেন। ইরান, তুরস্ক, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সৌদি আরবের রোহিঙ্গা নিয়ে আন্তর্জাতিক বলয়ে ভূমিকা খুবই ভাল।

মালেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার আমেরিকার সফরের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ফাঁকে রোহিঙ্গা বিষয়টা সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেছেন। আবার সৌদি বাদশা সালমান তার রাশিয়া সফরের সময়ও পুতিনকে একটা গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করেছেন। রোহিঙ্গারা মুসলমান। তারা দশকের পর দশক নির্যাতনের শিকার হয়েছে শুধু ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান হওয়ার কারণে।

বিশ থেকে ২২ লাখ লোককে মিয়ানমার নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। এতগুলো লোক রাষ্ট্র ছাড়া থাকে কি করে? বাংলাদেশ মানবীয় কারণে লাখ লাখ লোককে জায়গা দিয়েছে তবে বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, বছরের পর বছর, এ বোঝা টানতে পারবে। অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতেও কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন।

মনে হয় ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই রাখাইন থেকে সব রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে এসে যাবে কারণ মিয়ানমারের সৈন্যবাহিনী নাকি মাইকিং করে বলছে, বাংলাদেশ সীমান্ত খোলা আছে তোমরা বাংলাদেশে চলে যাও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো কথাই মানছে না মিয়ানমার। চীন, রাশিয়া, ভারতের সমর্থনের উপর ভর করে মিয়ানমার বেপোয়ারা হয়ে উঠেছে। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসিও এই বিষয়ে বৈঠকে বসা উচিৎ এবং বাংলাদেশ ওআইসির সভাপতিকে এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ডাকতে অনুরোধ করা প্রয়োজন।

বার্মাকে তাদের নেতারা এক ভাষার এক ধর্মের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই। এ কারণে তারা রোহিঙ্গা, কচিন ও কারেন্ট সম্প্রদায়কে কখনও সহ্য করেনি। রোহিঙ্গারা মুসলমান আর কচিন ও কারেন্ট সম্প্রদায় হলো খৃস্টান। বার্মায় খৃস্টান মোট জনসংখ্যার ৮% শতাংশ আর মুসলমান হচ্ছে ৫% শতাংশ। অর্থাৎ মুসলমান হচ্ছে ২৫ লাখ আর খৃস্টান হচ্ছে ৪০ লাখ। আর সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

বার্মার নেতারা ধর্মানুরাগী। অং সাং সু চির স্বামী ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বড় পণ্ডিত ও গবেষক, যদিওবা তিনি বৃটেনের লোক ছিলেন। বার্মায় ৫ লাখ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী রয়েছে। আর মঠ আছে এক লাখ। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বত্র ধর্মের প্রভাব রয়েছে। নেতাদের থেকে নিজের তলার মানুষ সবাই সম্প্রদায়িক। সুতরাং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্ত চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে মায়ানমার কোনোভাবেই গঠনমূলক কোনো সিদ্ধান্তে আসবে না।
বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাহায্য চেয়ে স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসির সূচনা করল। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর এক সঙ্গে বসবাস করেছি। পরস্পরের সমস্যাগুলো সম্পর্কে পরস্পর অবগত আছি। সাহায্য করার ইচ্ছা পোষণ করলে কার্যকরভাবে পরস্পরকে সাহায্য করা সম্ভব।

রাশিয়া, চীন, ভারত, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের পক্ষে নেই। ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে তারা মিয়ানমারের গণহত্যাকেও চোখ বন্ধ করে সমর্থন করছে। অথচ এ সমস্যায় চীন-রাশিয়া উদ্যোগী হলে সম্মানজনকভাবে সমাধান করে দিতে পারতো। তারা জাতিসংঘের যে কোনো উদ্যোগে ভেটো দেবে এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গা বিতাড়নের বিষয়ে একরোখা হয়ে বসে আছে।

চীন-ভারত বাংলাদেশের পক্ষে নেই এই ভেবে হতাশ হলে চলবে না। এ সমস্যায় সমাধানে বাংলাদেশকে নতুন নতুন পথ উন্মোচন করার চেষ্টা করতে হবে। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন করেনি। আমেরিকা এবং চীন তখন পরস্পরের দোসর ছিলো। এখন চীন রাশিয়ার দোসর হয়েছে। বড়শক্তিগুলো কখনও কারো স্বার্থে পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয় না। তারা তাদের অনুকূলে অবস্থান নেয়। এই কারণে বিশ্বের সমস্যাগুলোর যে নিষ্পত্তি হচ্ছে না তা নয়। অবশ্য বড় শক্তির খেলায় সমস্যাগুলোর হয়তো সমাধান হতে সময় নিচ্ছে।

গত কয়দিন আগে ‘সুজন’ নামের এক এনজিও গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিলো। তারা বলেছে কূটনৈতিক কর্মতৎপরতায় বাংলাদেশ নাকি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কিছু লেখক এই মর্মে কলামও লিখছেন। জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মাঝে তিন সদস্য রোহিঙ্গাদের পক্ষে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশই রোহিঙ্গাদের পক্ষে। তারা মিয়ানমারে অবরোধ আরোপের কথা বলছেন। সারা মুসলিম বিশ্ব রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করছেন।

পাকিস্তানও মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের কারণে হয়ত তারা নিষ্ক্রিয়ও থাকতে পারে। বাংলাদেশের হাই কমিশনার পাকিস্তানের সঙ্গে দেখা করে এবং আন্তর্জাতিক বলয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে উত্তম কাজই করেছেন। পাকিস্তান এটমিক বোমার মালিক, তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষ অবলম্বন করে কাজ করলে রোহিঙ্গারা উপকৃত হবে। উপকৃত হবে বাংলাদেশও।

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও শিক্ষক।
anisalamgir@gmail.com  

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, ১৭ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ