খান আতা কি আসলেই দেশদ্রোহী ছিলেন?

মোস্তফা মনন
‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে’- ৭০’র আন্দোলনে দাপিয়ে বেড়ানো এ কালজয়ী লেখক আর সুরকার হলেন খান আতাউর রহমার। যাকে খান আতা নামে সবাই চেনেন এবং জানেন। সম্প্রতি খান আতাকে \’রাজাকার\’ বলে অভিহিত করেছেন সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি প্রমাণও দিয়েছেন।

তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অপারগ হয়েছিলেন। যে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী ১৯৭১’র ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে ‘আওয়ামী লীগের চরমপন্থীদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান সেই তালিকার ৯ নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। ১৭ মে ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা দ্রষ্টব্য।

• ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছিলেন রেডিও টেলিভিশনে পাকিস্তানিদের প্রচারকার্যে সহযোগিতাকারীদের শনাক্ত করার জন্য। ১৯৭২-এর ১৩ মে নীলিমা ইব্রাহীম কমিটি যে তালিকা সরকারকে পেশ করে সে তালিকায় ৩৫ নম্বর নামটি খান আতাউর রহমানের। তালিকাভুক্তদের সম্পর্কে কমিটির সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তালিকাভুক্ত শিল্পীদের ছয় মাস পর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করা হয়। দ্রষ্টব্য- বাংলাদেশ বেতার তথ্য মন্ত্রণালয়ের নং জি১১। সি-১।৭২।১৬/৬/৭২\’’
সূত্র. এনটিভি অন লাইন ১৬.১০.১৭

এ সম্পর্কে খান আতার ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেছেন, ‘এখনও অনেক রাত’ ছবির মহরত অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে খান আতাউর রহমান বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালীন আমি একটি বিবৃতিতে সই করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সই করার আগে সেখানে আরেকটি সই দেখতে পাই। তাৎক্ষণিক তাকে ফোন দিই ‘আপনি সই করেছেন দেখছি ওরা অস্ত্রসহ এসেছে, আমি কি করব? টেলিফোনের ওপাশ থেকে জবাব আসে দিয়ে দেন। আমি সই করি। বিশ্বাস না হলে আজকে আমার মহরত উদ্বোধন করতে আসা কবি সুফিয়া কামালকে জিজ্ঞাসা করুন।’ (মাহবুব আজাদ রচিত খান আতাউর রহমান। বাংলা একাডেমি। প্রকাশকাল ২০০১)।

আমরা জানি, ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক কিছু তৎক্ষণাৎ আদায় করা যায়, পরে তা বোঝাও যায়, কোনটা চেতনার প্রশ্ন, কোনটা ভয়ের মাধ্যমে আদায় করে নেয়া। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জজ মিয়ার সাক্ষী পরে টেকেনি, কারণ তা ভয়ের মাধ্যমে আদায় করে নেয়া ছিল।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্য যখন ঢাকা অ্যাটাক করে তখন খান আতা গুলিস্তান অফিসে ইস্ট পাকিস্তান প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির বৈঠক করছিলেন। আক্রমণের কথা শুনে ইস্ট পাকিস্তানের স্থলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে করেন বাংলাদেশ প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি। সভায় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জহির রায়হান ও আলমগীর কুমকুম উপস্থিত ছিলেন। নিশ্চয়ই জহির রায়হানরা দেশদ্রোহীর সাথে এমন কাজ করবেন না।

যদি চেতনার প্রশ্নে আসি, দেখতে পাব, খান আতা দেশপ্রেমিক না দেশদ্রোহী?

ধারাবাহিক ভাবে দেখলে দেখা যাবে, ‘জাগোহুয়া সাভেরা’ থেকে শুরু করে ‘জীবন থেকে নেওয়া’ পর্যন্ত তার সংস্কৃতি ভ্রমণ আমাদের সামনে তাকে তুলে ধরবে সহজেই। এ জে কার্দারের সহকারী পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের যোগদান থেকে শুরু করে এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার (১৯৫৯)’ ছবিতে সংগীত পরিচালনা এবং পরে জহির রায়হানের কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল, সাঙ্গাম, বাহানা, সবগুলো সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসেবে তার কাজ করাই প্রমাণ করে, তিনি কোন চেতনার মানুষ। বলে রাখা ভালো, জহির রায়হান ভাষা সংগ্রামী ছিলেন। তারা নিশ্চয়ই দেশদ্রোহীদের সাথে কাজ করতেন না।

আর নবাব সিরাজউদ্দোলা সিনেমা তো জাতীয়তাদী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া প্রথম সিনেমা, যার পরিচালক খান আতা। এই সিনেমা বাঙলা ও উর্দু দুটি ভাষাতেই চলেছে।

আওয়ামী লীগের কোনো একটা মতের সাথে অমিল থাকা মানে এই না যে, দেশের চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়া। তা হলে ১৯৫২ সালে ভাষা সংগ্রাম পরিষদের মিটিং হয় ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নবাবপুরের একটি বাসায়। সেখানে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে ভোট দেয় ১১ জন। সেই এগার জনের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা ছিল। শুধু ভাষা মতিন, তোহা আর একজন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ভোট দেয়। আমরা কি তখন বলব, যে আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলন হোক, তা চায় না? তা কিন্ত না।

ভাষা আন্দোলন যখন দানা বাঁধে, তখন জিন্নার সফরের সূচি চুড়ান্ত হয়। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ সাল। মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন এ বিষয়ে কামরুদ্দীন আহমদ অধ্যাপক আবুল কাশেমের মাধ্যমে জেলে আটক নেতাদের মুক্তির শর্তে একটি আপস ফর্মুলাায় পৌঁছায়। জিন্নার সফরে যেন ঢাকায় কোনো মিছিল-মিটিং না হয়। জেলে আটক নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। তার মানে কি এই, তাদের মুক্তির জন্য ভাষা সংগ্রাম জলাঞ্জলি দিয়েছে? না, বিষয়টা তা না।

যুদ্ধের দুই নিয়মই প্রচলিত। যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাওয়া- বাঁচো বা মরো। আবার অবস্থা বুঝে একটু পিছিয়ে নিয়ে আবার যুদ্ধ করা। পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বাবর জয়ী হয়েছিল। যদি প্রথম যুদ্ধেই মারা যেতেন, তাহলে পরের যুদ্ধে সে জয় লাভ করতে পারতেন না।

খান আতা তখন বাধ্য হয়ে সেখানে স্বাক্ষর না করলে তাকে আমরা হয়তো হারাতাম, যেমন হারিয়েছি শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদকে। যদি তাকে হারাতাম তাহলে পরে তার কাছ থেকে পেতাম না কালজয়ী অমর কিছু কাজ- ‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ, হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি, রূপ দেখে তোর কেমনো আমার পরাণ ভরে না বা নয়নমণি দেশ আমার সোনা মণির দেশ আমার। দেশের ক্লান্তিকালে আবার গেয়ে উঠতেন না ‘ও আমার জন্মভূমি তুই স্বাধীন হবি কবে, আরো কত রক্ত দিবো, এই যুদ্ধ শেষ হবে কবে?’

ষাটের দশকের কথায় আসি, পাকিস্তান রেডিও লাহোর শাখায় কাজ করতেন ফতেহ লোহানী। সেখানে খান আতাকে সংবাদ পাঠের কাজ দেয়া হয়। কাজ করতে গেলে বাঙালি অফিসারদের পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসাররা ভালোভাবে দেখত না। নানাভাবে ঝামেলা করতে। সংবাদ পাঠের সাথে সাথে স্ক্রিপ্ট দিত- যেন ভুল করে, যার ফলে তাকে চাকরি থেকে বাদ দিতে পারে। যদিও স্ক্রিপ্ট দেয়ার নিয়ম আরও অনেক আগে। খান আতা এসব অত্যাচার নিয়েও কিছু দিন কাজ করলেন। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানিকে ঘুষি দিলেন, শেষে তাকে বলা হলো, লিখিত মাফ চাইতে হবে, তা না হলে চাকরি চলে যাবে। খান আতা মাফ চাননি ওই পাকিস্তানি অফিসারের কাছে। কারণ, অন্যায় তিনি করেননি। তিনি চাকরি ছেড়ে লন্ডন চলে যান।

লন্ডনে তার বন্ধু ছিলেন চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। এমনও হয়েছে, হোটেল বিল পরিশোধ করতে না পেরে সুলতানকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে সেই ছবি হোটেল মালিককে দিয়েছেন।

সত্তর দশকের গণঅান্দোলনের কথা আমরা জানি। সে সময় যে যার জায়গা থেকে লড়াই করেছেন। খান আতারাও করেছেন। তাদের একটা ছোট্ট দল ছিল, খান আতা, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, আমজাদ হোসেন। এই চারজন মিলে তৈরি করেন বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’। পাকিস্তানে বসে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিনেমা বানানো সহজ কথা নয়। বর্তমান সময়ে তো সরকারের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যায় না। আর সে সময়ে জীবনবাজি রেখে তারা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেন। দেশপ্রেমের চেতনা না থাকলে এ কাজ করা সম্ভব নয়। নিশ্চয় জহির রায়হানরা দেশদ্রোহী (!) খান আতার সাথে মিলে এই কাজ করতেন না!

সিনেমা বানানো হলো, তবে মুক্তি পেল না। পাকিস্তান ফিল্ম কর্পোরেশনের ছাড়পত্র মিলছে না। তখন এই খান আতাই রাতে গিয়ে মহাপরিচালকের সাথে মিটিং করে এবং বুঝাতে সক্ষম হন। তারপর এই সিনেমা আলোর মুখ দেখেছিল।

পরে ‘জীবন থেকে নেওয়া’ মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যায়, তবে সাব টাইটেল না থাকায় বাদ পড়ে। তখন খান আতা নিজ থেকে দায়িত্ব নেন, সে সিনেমা চলাকালীন সময়ে মাইক্রোফোনে লাইভ কমেন্ট্রি করবেন। ইংরেজিতে সবার সংলাপ পড়ে যায়। তবুও দেশপ্রেমের এই সিনেমা চলবেই। পড়ে পুরস্কারও পেয়েছিল।

‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন খান আতা। সে সময়ে রবি ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা, এই গানের মিউজিক করেন খান আতা। যা পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দারুণভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে। সে কথা ভুললে চলবে না।

একটু মনে করিয়ে দেই, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল এই সোনার বাংলা গানটি। রবি ঠাকুর চায় না, বাংলা ভাগ হোক, কিন্তু বাংলা ভাগ হলে আমাদেরই লাভ। তার মানে কি এই রবি ঠাকুর বাংলাকে ভালোবাসেন না?

৭ মার্চের ভাষণ শেষে শেখ মুজিবুর রহমান জয় বাংলা বলার পর জয় পাকিস্তান বলেছিল, তার মানে কি এই, জাতির পিতা দেশকে ভালোবাসেন নাই?

আর স্বাধীনতার যুদ্ধ কি শুধু অস্ত্র হাতেই হয়েছে? যারা বেতারে ছিল, যারা কলাম লিখত, যারা পথনাটক বা গণসংগীত করত, যারা চলচ্চিত্র বানাত, তারা কি যোদ্ধা না?

শেষ কথা বলি, একজন মানুষকে চেনা যায় তার চেতনা দিয়ে, ক্ষণিকের একটু সময়ের বাধ্য হয়ে একটি স্বাক্ষর করা নিয়ে বেশি চিৎকার করাটা বড়ই বেমানান। তাহলে একাত্তরে যেসব হিন্দু ধর্মের মানুষ পাকিস্তানের বন্দুকের মুখে কলেমা পড়েছিল, তারা সবাই মুসলমান হয় যেত, কিন্তু তারা মুসলমান হয়নি। কারণ, তারা ভয়ে এই কাজ করেছিল, বিপদে পড়ে।

কিছু প্রশ্ন তো করাই যায়- খান আতা একুশে পদক পেয়েছেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। একজন দেশদ্রোহী এতসব কিছু কীভাবে পায়, তা আমাদের সংস্কৃতবান ব্যক্তিরা কী বলতে পারবেন?

লেখক : মোস্তফা মনন
নাট্যকার ও নির্মাতা

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, ১৭ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম