সংস্কৃতির একাল সেকাল

দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা
সংস্কৃতি বলতে একটি জাতি বা সমাজের বেশ কিছু রীতি নীতিকে বোঝায় যার মাধ্যমে মানুষ তার দৈনন্দিন কর্ম, সামাজিক, ধর্মীয় বা আদর্শিক প্রতিফলন ঘটায়। তবে স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের সংজ্ঞা অনুযায়ী, “সংস্কৃতি বলতে সেই সব পন্থাকে বোঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে ওঠে এবং ছলনাময় কৌশলের মাধ্যমে পূর্ণরুপে মানুষে পরিণত হয়।”

তবে বাঙালি সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে “সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্জিত কীর্তিসমূহ”।

বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি তা আবহমান কাল থেকে পরম্পরায় চলে আসছে। তবে বাঙালি সংস্কৃতি যতটা সমৃদ্ধ অন্য কোন সংস্কৃতি এতটা সমৃদ্ধ নয়। বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় গুণটা মানবতাবাদ। পরস্পরের ভালবাসা। যদি সেকালের সংস্কৃতির সাথে আমরা একালের সংস্কৃতির তুলনা করি তাহলে দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যাবে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের নাম “সংস্কৃতির ভাঙা সেতু”। এই প্রবন্ধে তিনি তখনকার বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত সত্য রুপ তুলে ধরেছেন। তার প্রবন্ধটির নামকরণের সার্থকতা বলছি না। শুধু বলছি আমরা এখন যে সমাজে বসবাস করছি তাকে শুধু ভাঙা সেতুর সাথেই কেবল তুলনা করা যায়।

বাঙালি সংস্কৃতির কয়েকটি কাল রয়েছে তার মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময় এবং পূর্ব বাংলার নব জাগরণ বাঙালি সংস্কৃতি একটি কাল। এই সময়ে যে সংস্কৃতি ধারা সৃষ্টি হয় সেখানে দেখা যায় পুরাতন সংস্কৃতির বেড়া জাল ভেঙে নতুন ধারা চালু হয়। একটি শিক্ষিত সমাজ আর মধ্যবৃত্ত পরিবার নির্ণয় শুরু হতে থাকে। তখনো সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু রীতিনীতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। যৌথ পরিবার তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সে যৌথ পরিবার আর শেষ পর্যন্ত টিকে নাই।

সেকালের সংস্কৃতির মধ্যে সামাজিক সংস্কৃতিটাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। আর সংস্কৃতির স্তম্ভ হল গ্রাম। সেখানে দেখা যায় সমাজের কেউ বিপদে পড়লে বাকিরা তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে সাহায্য করেছে। প্রতিবেশীর বিপদ মানেই সমাজের প্রতিটা মানুষের বিপদ। তাদের মধ্যে লেখা পড়া কম থাকলেও ভালবাসার প্রগাঢ়তা ছিলো অনেক বেশি। ছেলে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া, মসুলমানী করানো সব কিছু করার আগে সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতো। সমাজে একজন নেতা থাকতো তার কথা মতো বা পরামর্শে কাজ করতো।সে সমাজ কতই না ভাল ছিল।

কিন্তু আজ সামাজিক বিয়ে গুলো আর সেভাবে হয় না। মুরুব্বীদের কথার কোন ধার ধারে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো বিয়ে সাদি করছে আবার নিজেরদের ইচ্ছাতেই ছাড়া ছাড়ি হচ্ছে।

পরিবারের কারও বিবাহ দেওয়ার প্রয়োজন হলে উভয় পক্ষই বংশের খোঁজ নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতো। চেহারের চেয়ে বংশ পরিচয়ই তাদের কাছে মুখ্য ছিলো। কিন্তু এখন অনেকে তার নিজের বংশের নামই জানে না তাহলে অন্যের বংশ পরিচয়ের জানার আগ্রহ থাকবে কি ভাবে?
ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছি- ভাদর মাস আসলেই গ্রামে গ্রামে লায়ারের( বেড়ানো) ধুম পড়ে যেত। এই সময় ভরা বর্ষার সময়। গ্রামের কৃষকদের কোন কাজ থাকতো না। তাই তারা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যেতো। বিশেষ করে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে যেতো। দেখা যেতো মেয়েকে নেওয়ার জন্য বাবা বড় নৌকা পাঠিয়ে দিয়েছে আর সাথে নানা রকম ফল, পান সুপারি। সবচেয়ে ভাল লাগতো নতুন বউয়ের বেলায়। গ্রামে একটা রীতি ছিল ভাদর মাসে মেয়েরা যদি বাপের বাড়ি যায় তাহলে সমস্ত মাস বাপের বাড়ি থাকতে হতো। তা না হলে অমঙ্গল হবে। আবার কারও বাড়িতে বেড়াতে গেলে মিষ্টি বা রসগোল্লার সাথে পান সুপারি আনতেই হবে।

নতুন আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেলে সাধ্য মত উপহার দিত। এখন আর সে নিয়ম কেউ পালন করে না। নবান্ন,শীত, বর্ষার দিনে পিঠা পুলির ধুম পড়ে না।

মেয়েরা বাপের বাড়িতে আগের মতো সোয়ারী হয়ে বেড়াতে আসে না।

এখন আর যৌথ পরিবার নেই সব ভেঙে ছাড়খাড় হয়ে গেছে। সব একান্ন বর্তী পরিবার। যার ফলে সমাজে অনেক অনিয়ম চালু হয়েছে।
খেলাধুলার ক্ষেত্রেও এসেছে আমুল পরিবর্তন। সেকালের খেলাধুলা ছিলো সব মজার মজার দেশি খেলা। হা-ডু-ডু, কানামাছি, বৌ ছি, গোল্লাছুট, লবণ দাঁড়ি, ডাংগুলি, মার্বেল। আশ্বিন মাস এলেই নদীর ধারে মেলা বসতো, নৌকা বাইচ হতো, এখন সে ভাবে আর মেলাও হয় না, নৌকা বাইচও হয় না। মেলাতে কত রকম মাটির হাঁড়ি পাতিল পাওয়া যেত। এখন আর সে খেলাগুলো নেই। পাড়ার ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে এখন আর কানামাছি, বৌ ছি খেলে না। ছেলেরা ছেলেরা দোস্ত পাতাই না, মেয়েরা মেয়েরা সই পাতাই না। এখন আর বিকেল হলে সব কাজ সেরে কেউ প্রতিবেশির বাড়িতে বেড়াতে যায় না।

আহ! কত দোস্ত, কত সই ছিলো। এখন নাই। এখন আর কোন মায়ের মুখে বা বোনের মুখে শুনি না, আমার সই কেমন আছে! সইরে কত কাল দেখি না।

কোন বাবা ছেলেকে হাত ধরে বলে না- চল আমার দোস্ত বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ছিল কত আনন্দের। ভাল স্বচ্ছল পরিবারের প্রায় সবারই কাচারি ঘর ছিলো। কোন আগন্তক বা অাত্মীয় আসলে প্রথমে কাচারি ঘরেও বসতে দিতো। মসজিদের ইমাম ছিল সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। মসজিদের ইমাম সাহেব বিভিন্ন মিলাদ মাহফিল ছাড়াও বিকেল বেলা সমস্ত গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন, সবার খোঁজ খবর রাখতেন। সে মিথ্যা কথা বলতো না। এখন আর এমন মানুষ নাই। সব পাল্টে গেছে। হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের ভাই ভাই সম্পর্ক ছিল। এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল গোটা সমাজ। হিন্দুদের বার মাসে তের পার্বণ। সব ক্ষেত্রেই সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতো মুসলমান ভাইয়েরা।

আগে বিনোদন বলতে শুধু যাত্রা বা গ্রামে গ্রামে গানের আসর বসতো। মারফতি, বাউল, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া কত রকম গান হতো। সারা দিন কাজ করে রাতে সবাই যেকোন একটি বাড়িতে একত্রিত হয়ে সবাই আসরে যোগ দিতো। সবাই সবার বাড়িতে যেতো কোথাও কোন বাধা ছিল না। সবাই ছিল ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ, অতি আপন জন। এখন আর সে ভালবাসা নেই। এখন কেউ কারও বাড়িতে যায় না, বাড়িগুলোর মধ্যে অনেক ভাগ। এখন আর গানের আসর বসে না।

চৈত্র মাসে আমাদের এলাকায় নতুন কিছু ফসল উঠতো, যেমন পিঁয়াজ, কলাই, ছোলা, ধানসহ আরো অনেক ফসল। এই সময় এলাকায় হালখাতার ধুম পড়ে যেতো। এখন আর শুভ হালখাতা সে ভাবে চোখে পড়ে না।

এখনকার সংস্কৃতি বলতে তেমন কিছু নেই। যা আছে মিশ্র সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি। বাঙালিয়ানা বলতে যা বোঝায় সেটা আর কেউ বহন করে না। আমাদের বসবাস সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর সাথে।

নেই কোন ভালবাসা, নেই কোন মানুষে মানুষে মমত্ববোধ। এ সমাজ কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে। সবাই ব্যস্ত যে যার মতো। সময় অতি দ্রুত চলে যায়। জীবনের সাদ অপূর্ণ রয়ে যায়। হিংসা প্রতিহিংসায় চলছে দিনাপাত। আমার আবহমান কালের সংস্কৃতি এখন কেউ ধারণ করে না, বহন করে না যুগ যুগ ধরে চলে আসা কত রীতি।

দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা
দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম