মাদার অব হিউম্যানিটি থেকে নোবেল লরিয়েট

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপের জন্য ব্রিটিশ গণমাধ্যম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। চ্যানেল ফোরের ওই প্রতিবেদনটি ফেসবুকে গত চব্বিশ ঘণ্টায় প্রায় দুই লাখ দর্শক দেখেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় হয়তো আরো কোটি দর্শকের কাছে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মানবিকতার এই দৃষ্টান্ত। দরিদ্র এই দেশের মানুষের হৃদয় যে কত বড় সেটি দেখল বিশ্ববাসী।

ভিডিওটিতে জুলস গার্নেল মন্তব্য করেছেন, দরিদ্র এই মানুষগুলোকে দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি, এটি বৌদ্ধধর্মের নীতি নয়। অং সান সুচি’র নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করা উচিত, তার কার্যক্রম অমানবিক। বাংলাদেশের প্রচুর বৈশ্বিক সাহায্য প্রয়োজন।

জুলস গার্নেলের ওই মন্তব্যটিতে লাইক দিয়েছেন ৩৬৮ জন। জুলস গার্নেলের মতো ব্রিটেনের ৪ লাখ জনগণ একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করে সুচি’র নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে সুচির বিচারের দাবি তুলেছে। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর তারা এই পিটিশনটি ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র দফতরে হস্তান্তর করবেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টনিও গুটরেজ জাতিগত সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যে সকল নাগরিক সেনা অভিযানের কারণে বার্মা ত্যাগ করেছেন তাদের ফিরে আসার অধিকার দেয়ার জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমার কী আদৌ জাতিসংঘ মহাসচিবের এই আহ্বানে সাড়া দেবে?

ইতোপূর্বে ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান মিয়ানমারে জাতিগত নিধন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতি, তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকারের বিষয় উল্লেখ করে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। সুচি গত ৫ বছরে সেই দাবি বাস্তবায়ন করেননি। তাই জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিবের এই মৃদু উচ্চারণে মিয়ানমারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী কতটুকু কর্ণপাত করবে সেটি বুঝতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। যারা আন্তর্জাতিক বিশ্বের খবর রাখেন তারা জানেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর সুচির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জানে, তাদের পেছনে রয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য চীন। গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে সদস্যভুক্ত ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র চীন বিরোধিতা করে। রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানালেও চীন মনে করে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী তার দেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে চীনের সমর্থন দেওয়ার পেছনে রয়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। মূলত ২০০৪ সালের দিকে রাখাইন রাজ্যে জ্বালানি সম্পদ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে আগ্রহ বাড়ে চীনের। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে চীনের বেইজিং ও মালাক্কা প্রণালি হয়ে আফ্রিকায় তেল সরবরাহের সুযোগ তৈরি হয়েছে, মিয়ানমারের কিয়াউকফিউক হয়ে চিনের কুনমিংকে যুক্ত করা পাইপলাইনের কারণে। এছাড়াও অং সান সুচিকে ক্ষমতায় বসাতে বেইজিং সরকারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। মিয়ানমার ও চীনের রয়েছে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য। তাই সবকিছু মিলিয়ে চীনের সামরিক সরকারের সঙ্গে বেইজিং-এর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান খুব সহজ হবে না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রতিবেশি দেশ চীন ও ভারত অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে।

২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে ৩ লাখ ৭০ হাজার। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। মানবিকতার খাতিরে দুই দফায় বাংলাদেশ প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি আসলে কি? তার আগে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের আসলে কোন দেশে ফেরত পাঠানো হবে?

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেন, তবে অবশ্যই কাগজপত্র দেখে, যাচাই-বাছাই করে। তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, নির্বিচারে হত্যা আর ধর্ষণ চালিয়ে যে মানুষগুলোকে আরাকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে তাদের কাছে কাগজ বা পরিচয়পত্র চাওয়া রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়। তবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ১৯৬৭ সালের ইউএন ট্রিটির বাস্তবায়নে বিশ্বনেতাদের সহায়তা চাইতে পারে। ১৪৫টি দেশ এই ট্রিটিতে স্বাক্ষরকারী। যদিও বাংলাদেশ, মিয়ানমার. ভারত এই চুক্তির বাইরে রয়েছে। তবে আশার কথা হল, ১৯৬৭ ইউএন ট্রিটিতে চীন ও তুরস্ক অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। এই চুক্তিতে যারাই স্বাক্ষর করে তারা রিফিউজি গ্রহণ করার জন্য সম্মত হয়। চুক্তি অনুযায়ী দেশগুলো প্রয়োজনে রিফিউজি নিতে বাধ্য থাকবে। চীন যদিও এই ট্রিটির স্বাক্ষরকারী দেশ কিন্তু রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ যেহেতু মুসলিম এবং বাংলায় কথা বলে তাদের হয়তো চীন গ্রহণ করতে চাইবে না।

অন্যদিকে ভারতে যে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে নতুন করে। তাহলে সমাধান কী হতে পারে? এ প্রসঙ্গে মাইগ্রেন্ট ভয়েজের চেয়ারপারসন হাবিব রহমানের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। যিনি মাইগ্রেশন ও রিফিউজি ইস্যুতে কাজ করছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে। হাবিব রহমান জানালেন, বার্মিজ সরকার যদি তার নিজ দেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জাতিসংঘের মাধ্যমে বার্মায় একটি সেইফ জোন তৈরি করে শান্তিরক্ষায় ইউএন-এর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রেরণ করতে পারে জাতিসংঘ। যে কথাটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যেও বলেছেন। যেমনটা হয়েছিল বসনিয়ার বেলায় ১৯৯৫ সালে। বসনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করে সংহিসতা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

হাবিব রহমান আরো একটি কথা মনে করিয়ে দিলেন। রোহিঙ্গারা বছরের পর বছর রাখাইনে বসবাস করছে, সেই দেশে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। তারা কোন দেশ থেকে এসেছে সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। ব্রিটেনেও বহু অভিবাসী বিভিন্ন দেশ থেকে বছরের পর বছর ধরে থাকছে। রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্য থেকে বের করে দেয়া যদি নিয়ম হয় তাহলে তো ব্রিটেন যেকোনো ইস্যুতে শরণার্থীদের বের করে দিতে পারে। সেটা কি বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় সম্ভব? তাই রোহিঙ্গাদের বার্মায় থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার যেহেতু রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মানতে রাজি নয়, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তাই জাতিসংঘ আরাকান রাজ্য অথবা মিয়ানমারের ভেতরে অন্য কোনো সেইফ জোন ঘোষণা করে, সেখানে তাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে রিফিউজিদের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হলে ১৯৬৭-এর ইউএন ট্রিটির বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে। এই চুক্তিতে সাক্ষরকারী ১৪৫ টি দেশের সঙ্গে এখন কূটনৈতিক লবিং-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে, যেন তারা রোহিঙ্গাদের জাতিসংঘের অধীনে সেইফ জোন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। তবে যেহেতু বাংলাদেশ এই ট্রিটির স্বাক্ষরকারী দেশ নয়, তাই বাংলাদেশ যদি চীনকে দিয়ে এই প্রস্তাব উত্থাপন করাতে পারে তাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার নোবেল জয়ের সম্ভাবনা জোরালো হবে। কারণ চীনই হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদে অন্যতম ভেটো প্রদানকারী রাষ্ট্র, যারা ১৯৬৭ ইউএন ট্রিটির স্বাক্ষরকারী দেশ। তবে জাতিসংঘের অধীনে মিয়ানমারে সেইফ জোন প্রতিষ্ঠা করে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার অর্থ হল, ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যকে একটি স্বাধীন দেশ করার পথ সুগম করা। ভৌগলিক বাস্তবতায় মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার নেপথ্যে সহায়ক ভূমিকা পালনকারী দেশ হয়ে উঠার বাস্তবতা বিবেচনা করেই এগােতে হবে বাংলাদেশকে। তবে বর্তামান পেক্ষাপট বিবেচনায় কফি আনান কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নে জাতিসংঘের ভূমিকাকে আরো শক্তিশালী করতে পারলেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।

১৬ কোটি জনগণের বাংলাদেশ ৮ লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে মানবিকতার খাতিরে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে রোাহিঙ্গারা সংকট তৈরি করবে, তাতে সন্দেহ নাই। তাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগে চীন ও ভারতের সমর্থন আদায় হবে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে যেমন শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব পেলেন, তেমনি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করে শেখ হাসিনা হয়ে উঠতে পারেন শান্তির প্রতীক।

লেখক : কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, চ্যানেল এস টেলিভিশন, লন্ডন ও যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, একাত্তর টেলিভিশন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম