রিফিউজি বাতাসে বাংলা মন

পর্যবেক্ষণ

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
‘ছোট্ট একটা দেশ। তাকে নিয়ে কত খেলা, আর কত যে খেলোয়াড়।

’ রোহিঙ্গা ইস্যু, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক বানোয়াট খবর, সামাজিক মাধ্যমে মুসলিমপ্রীতি ও মুসলিমভীতিবিষয়ক আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ এসব বিষয়-আশয় মিলিয়ে এই ছিল আমার সরল প্রতিক্রিয়া।

আমি ফিল্মমেকার। রাজনীতিক নই। রাজনৈতিক কোনো অভিলাষও আমার নেই। কোনো বিশেষ দলমতের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যও নেই। কিন্তু আমার চারপাশে যা ঘটে তা তো আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সেই জায়গা থেকেই মাঝেমধ্যে কিছু বলা। এর আগেও আমি বলেছি, প্রাণ রক্ষার তাগিদে দেশ ছেড়ে পালানো লাখ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে যে অবস্থানে নিয়ে গেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসেই বড় করে লেখা থাকবে। এই রোহিঙ্গারা কারা, ইতিহাসের কোন জটিল পাঁকে পড়ে তাদের আজ এই অসহায় অবস্থা এই বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করছি। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের মাজেজা ও ঝুঁকি দুটিই একটু ব্যাখ্যা করতে চাই। আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর এই মহত্ত্বের প্রশংসা করে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছি তখন আমার ইনবক্স ভরে গেছে এই প্রশ্নে যে, আমি কবে আওয়ামী লীগে যোগ দিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন নয়। মাঝেমধ্যে আমার বিভিন্ন মন্তব্যকে কেন্দ্র করে আমাকে প্রায়ই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি মাঝেমধ্যে জামায়াতেও যোগ দেওয়ানো হয়। কিন্তু সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। তাই বলে যাই।

জিওপলিটিক্সের ভাব-চক্কর না বুঝে এই সময়ে এমন কোনো আলোচনা করাই সম্ভব নয়। এটা যদি মাথায় রাখি তাহলে আমরা বুঝব শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত এই সময়ের বিচারে তার জন্য কতটা নাজুক। কিন্তু তিনি সময়ের লাভালাভের ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠে মহাকালের পরীক্ষায় নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন অসহায় এবং প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে। এটা সত্য, এই দাঁড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সামনে অনেক জটিল প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে। এতগুলো মানুষকে দিনের পর দিন খাওয়ানোর উপায় কী? এদের ফেরত পাঠানোর উপায় কী? এদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে রাখার উপায় কী? এই প্রশ্নগুলোর সমাধান খুঁজতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এক বিশাল চাপ যাবে। এ চাপ যে যাবে এটা কি প্রধানমন্ত্রী জানতেন না? জানতেন। তাহলে তিনি কেন এই চাপ নিলেন? এখানেই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে মানবতার দূতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসে। তিনি এই চাপ এড়ানোর জন্য যে কাজ করতে পারতেন তা হলো সীমান্ত পুরোপুরি সিল করে বন্দুক হাতে সীমান্তরক্ষীদের দাঁড় করিয়ে দিতে। তাহলে ভাবুন অবস্থাটা কী দাঁড়াত? ৪ লাখ মানুষের রক্তে ভেসে যেত নাফ নদ। কেউ বাঁচাতে পারত না তাদের। কোনো সিএনএন, কোনো বিবিসি একটা কথাও বলত না তখন আর। ৪ লাখ মানুষ, ৪ লাখ কালো মানুষ-বাদামি মানুষ-ফরসা মানুষ। তার মাঝে থাকত ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ, গায়ক মানুষ, শ্রোতা মানুষ, কর্মঠ মানুষ, অলস মানুষ, আস্তিক মানুষ, নাস্তিক মানুষ, সুখী মানুষ, অসুখী মানুষ, সংসারী মানুষ, বৈরাগী মানুষ। সবার রক্ত মিলেমিশে বয়ে যেত নাফ নদ দিয়ে। একবার চোখ বন্ধ করে আমরা ভাবতে পারি কত বড় গণহত্যার কলঙ্ক থেকে মানবজাতির ইতিহাসকে রক্ষা করেছে প্রধানমন্ত্রীর এই এক সিদ্ধান্ত? দেশের মধ্যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করছেন এই বলে যে, এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা অপরাধীদেরও দেশে জায়গা দেওয়া হলো। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ যখন পালায় তখন তাকে আশ্রয় না দিয়ে এই কথা বলা যে কত বড় নিষ্ঠুরতা! যেন একাত্তরে আমরা যখন লাখে লাখে মানুষ ভারতে গিয়েছি, সবাই চারিত্রিক সনদ নিয়ে গেছি। যেন সবাই সততার পরীক্ষায় এক শয় এক শ পেয়ে রিফিউজি হয়েছি। প্রিয় ভাই ও বোনেরা! মনে রাখবেন, মানুষ যখন প্রাণে বাঁচতে দেশান্তরী হয় তখন তার একটাই পরিচয় থাকে— রিফিউজি, রিফিউজি এবং রিফিউজি। এবং তখন অন্য মানুষের একটাই কাজ হয়— আশ্রয় দেওয়া, আশ্রয় দেওয়া এবং আশ্রয় দেওয়া। এরপর যে কাজ তা হলো দেশের ভিতর ও বাইরে এই নৃশংসতা তুলে ধরা। কূটনৈতিক চেষ্টা দিয়ে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা। ইতিমধ্যেই বিশ্বজনমত মিয়ানমারের জন্য চাপ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ এই জায়গায়ও সফল হবে।

কিছু দিন আগে আমি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। তাদের চোখেমুখে আমি এক আশ্চর্য জিনিস দেখেছি। দেখি সবার চোখ একই রকম। দেখে মনে হয়েছে এই চোখ আমি আগেও দেখেছি। খেয়াল করার চেষ্টা করলাম কোথায়, কোথায়, কোথায় দেখেছি। তখন মনে করতে পারিনি। এখন মনে পড়ছে। ইউরোপের কোনো দেশের সীমান্তে আশ্রয়ের অপেক্ষায় থাকা সিরিয়ানদের মধ্যে দেখেছি, একাত্তরে ভারতের শরণার্থী শিবিরের স্থিরচিত্রগুলোয় দেখেছি। বালুচিস্তানে নির্যাতিত হিন্দুদের চোখে দেখেছি, মার্কিন মুলুকের কালো মানুষদের চোখের তারায় দেখেছি। এই মানুষগুলো রাজনীতির কুটিল পাঁকে পড়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা তাদের দিয়েছিলেন জমিন। সেই জমিনে শত শত বছর তারা লাঙল ফলিয়েছে, বীজ বুনেছে, ফসল তুলেছে। হঠাৎ একদিন কিছু সেনা এসে সীমানা এঁকে বলল, ‘এই সীমানা আরাকান দেশের। তোমরা আরাকান রাজ্যের প্রজা। ’ তারপর ব্রিটিশরা এসে পতাকা গেড়ে বলল, ‘তোমরা ব্রিটিশরাজের প্রজা। ’ তারা তাই হয়ে গেল। তারপর একসময় ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় নাফ নদের দুই পাড় দুই ভাগে কেটে বলল, ‘তোমরা এবার বার্মারাজের প্রজা। ’ এতগুলো বছর পর এবার বার্মারাজ বলছে, ‘তোমরা আমার প্রজা নও। ’ এই যে সীমানা আর সীমান্তের কুটিল প্যাঁচ, এ প্যাঁচ ঈশ্বরের দান নয়। ঈশ্বরের দুনিয়ায় এই প্যাঁচ নিয়ে আজ তারা দিশাহারা। আশা করি, এই প্যাঁচ সমাধান করার জন্য তারা একজন নেতা পাবেন। তার আগে আমাদের নেতারা আশা করি বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হবেন, মানুষকে তার জমিন থেকে উচ্ছেদ করার অধিকার কারও নেই। সুতরাং তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে তাদের জমিনে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম