প্রেমিকের সঙ্গে অবাধ মেলামেশায় বাধা, ব্যবসায়ীকে খুন স্ত্রী-কন্যার

প্রেমের নামে এক বেকার ছেলের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ের অবাধ মেলামেশা চলছিল। মেয়ের এ কথিত প্রেমের প্রতি মা-খালা ও ভাইয়ের সায় থাকলেও তা মেনে নিতে পারছিলেন না স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী বাবা তৈয়ব আলী (৫০)। আর এটি-ই কাল হয় ব্যবসায়ী বাবার। চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকার বাসায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা মিলে তৈয়ব আলীকে ব্যাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে বালিশ চাপা দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

শুক্রবার রাতের এ হত্যাকাণ্ডে হাত মেলায় মেয়ের কথিত প্রেমিক রাব্বি এবং তৈয়ব আলীর শ্যালিকা জাহানারা বেগমও। এখানেই শেষ নয় ঘাতকরা লাশ বাসায় রেখেই উৎসবে মেতে ওঠে। বিরিয়ানি খেয়ে পরদিন শনিবার রাতে লাশ বস্তায় ভরে রিকশার পাদানিতে করে লাশের ওপর পা রেখে পার্শ্ববর্তী খালে ফেলতে গিয়ে সব জানাজানি হয়। লাশ ফেলতে যাওয়ার সময় ২০ বছর বয়সী ভাই সোহেল আহমদ ও প্রেমিক রাব্বির সঙ্গে ফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিল তৈয়ব আলীর মেয়ে ১৮ বছর বয়সী বৃষ্টি আক্তার। কথিত প্রেমিক রাব্বির সঙ্গে বৃষ্টির কথোপকথনের ৭ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের অডিও সংবাদ মাধ্যমের হাতে এসেছে।

তৈয়ব আলীর এ হত্যাকাণ্ড সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় ঘাতক ছেলে সোহেল মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট শাহাদাত হোসেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া লাশ বহনকারী রিকশাচালক মো. ইউনুস ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। শনিবার রাতেই গ্রেফতার তৈয়ব আলীর ঘাতক স্ত্রী কোহিনুর বেগম (৪২), মেয়ে বৃষ্টি আক্তার (১৮), শ্যালিকা জাহানারা বেগমকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তৈয়ব আলীর মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে তার ভাই জসিম উদ্দিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে রোববার সন্ধ্যায় তাকে চৈতন্যগলি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

যেভাবে হত্যা করা হয় তৈয়ব আলীকে : পশ্চিম মাদারবাড়ি টং ফকির মাজার এলাকার চার তলা বাসায় এক মাস আগে পরিবার নিয়ে উঠেন তৈয়ব আলী। বখাটে যুবক রাব্বির সঙ্গে স্কুলপড়–য়া মেয়ের অবাধ মেলামেশা জানতে পেরে তৈয়ব আলী ক্ষুব্ধ হন। তিনি তার স্ত্রী ও মেয়েকে বকাঝকা করেন। এ নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে রাব্বি ফের বাসায় এলে আরও ক্ষিপ্ত হন তৈয়ব আলী। এ নিয়ে তৈয়ব আলীর সঙ্গে পরিবারের সবাই ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে মধ্যরাতে সোহেল ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে বাবাকে আঘাত করলে তৈয়ব আলী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সোহেলের সঙ্গে যুক্ত হয় মা ও খালা। তারা দু’জনেই তৈয়ব আলীর গলা চেপে ধরে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সোহেল বালিশ দিয়ে মুখ চেপে ধরে বাবার। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গোটা শরীর কাঁচি দিয়ে আঘাত করা হয়। তার শরীরে ৫০টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। পরে সোহেল হাত-পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

বাবার লাশ ফেলতে যেভাবে ধরা : শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিটি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের খালে লাশ ফেলতে যায় ছেলে সোহেল ও মেয়ের কথিত প্রেমিক রাব্বি। সেখানে সিসি ক্যামেরা বসানো ছিল। বস্তায় ভরে কিছু ফেলার এ দৃশ্য দেখে সন্দেহ হয় কার্গো মালিক মিঠুর। তিনি তার দারোয়ানকে সতর্ক করেন। দারোয়ান কাছে গিয়ে বস্তার ভেতরে মানুষের হাত-পা দেখতে পান। এতে তিনি খুনি খুনি বলে চিৎকার করে উঠেন। এ সময় লোকজন জড়ো হলে কথিত প্রেমিক রাব্বি দ্রুত পালিয়ে গেলেও তারা সোহেলকে আটক করে।

লাশ বাসায় রেখে চলে বিরিয়ানি খাওয়ার উৎসব : বাসায় লাশ রেখে চলে বিরিয়ানি খাওয়ার উৎসব। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বাড়িতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখতে পান। জানা গেছে, তৈয়ব আলীকে হত্যা করার পর দোকান থেকে বিরিয়ানি কিনে উৎসব করে খাওয়া-দাওয়া করা হয়। লাশ গায়েব করা নিয়ে শনিবার দিনে পরিবারের সদস্যরা বৈঠক করে। পরে রাত ১০টায় লাশটি বস্তায় ভরে খালে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। লাশ ফেলার সময় বৃষ্টির সঙ্গে তার কথিত প্রেমিক রাব্বির ফোনালাপের ৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপটি পাঠকের সামনে তুলে ধরা হল-

বৃষ্টি : হ্যালো, হ্যালো

রাব্বি : হ্যাঁ, জি

বৃষ্টি : কী কও তোমরা

রাব্বি : সোহেল ভাই ধরা খেয়ে গেছে-গা

বৃষ্টি : হ্যাঁ, তোমার কথা বুঝি না, রাব্বি

রাব্বি : সোহেল ভাই ধরা খেয়ে গেছে-গা

বৃষ্টি : কীভাবে?

রাব্বি : আমি এখন একটি জায়গায় লুকিয়ে আছি

বৃষ্টি : এখানে চিল্লাচিল্লি করতেছে সোহেল সোহেল করে

রাব্বি : চিন্তা করো না সোহেল ভাইকে ছেড়ে দেবে।

বৃষ্টি : তোর সাথে আম্মু দিছে নারে ভাই, সোহেল ভাই কই গেছে

রাব্বি : আমিও ধরা পড়ে যেতাম এটা জান?

বৃৃষ্টি : সোহেল ভাই এখন কই, সোহেল ভাই এখন কই

রাব্বি : সোহেলকে ওরা রাখছে

বৃষ্টি : কে রাখছে, কই রাখছে?

রাব্বি : তোমার স্কুলের এখানে

বৃষ্টি : এখানে ভাড়াটিয়ারা বলতেছে বস্তাভরে একটাকে ধরছে। আল্লারে …

রাব্বি : আমার কথা কাউকে বলিও না

বৃষ্টি : রাব্বি, তুই আমার ভাইরে আন, আমার ভাইরে আন

রাব্বি : ভাইকে ছেড়ে দেবে বলছি না আমি

বৃষ্টি : আল্লাহ রাব্বি এখানে মানুষ জমা হয়ে গেছে, আল্লাহ রাব্বি… ওই রাব্বি

রাব্বি : কোথায় মানুষ জমা হয়ে গেছে, ভয়ে আমার জ্বর উঠে গেছে

বৃষ্টি : এখানে সবাই চিল্লচিল্লি করতেছে। সবাইকে বলতেছে সোহেলকে নাকি ধরছে। সোহেলকে সবাই চিনে ফেলছে। চিনলে তো শেষ। তোরে আমি বলছিলামও এখানে ফেলিস না। এখন সোহেল ভাইকে কী করতেছে যে। সোহেল ভাইকে কী করে, আল্লাহ।

সোহেল ভাইকে ছেড়ে দিলে তুই যা না, সোহেল ভাইয়ের ফেসটা যেন কেউ না দেখে। যা না ভাই …

রাব্বি : সোহেল ভাইয়ের ফেস যখন ধরছে তখন সবাই দেখে ফেলছে।

বৃষ্টি : লাশ কই? লাশ কই?

রাব্বি : লাশ ফেলে দিছি আমরা

বৃষ্টি : লাশ ফেলে দিলে আমার ভাইরে কেন ধরে রাখছেরে, তুই যা না রে ভাই, তুই যা

রাব্বি : আমি পারতেছি না, একটা ফ্রেন্ডের বাসায় আছি। ছাড়বে ছাড়বে আমি বলছি না ছাড়বে

বৃষ্টি : এখানে সবাই বলতেছে পুলিশের কাছে ফোন দেবে,

রাব্বি : পুলিশকে দিলেও সমস্যা নেই, ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব

বৃষ্টি : কী? আমাদের গোষ্ঠীর কেউ জানে না তো প্লিজ তুই যা না ভাই। কেন বুঝছ না ছাড়িয়ে আনা বড় কথা না তো

রাব্বি : আমি পারতেছি না, প্লিজ আমাকে মাফ করো। আমার আব্বা এগুলো শুনলে তাকে মেডিকেল নিয়ে যেতে হবে। আব্বা মারা যাবে।

বৃষ্টি : তুই এখন লাশ নিয়ে যেয়ে আমার ভাইকে বাজাইছস। তুই এরকম কেন করতেছিস? তুই না পারলে আমাদের বলতি। তুই এজন্যই তো বলছিস আগে আপনি যানগে। এখন পুলিশওয়ালাগোর কাছে নিয়ে গেলে আমরা কি করব? ওরে কোন জায়গায় ধরে রাখছে? আমাদের স্কুলের সামনে? ক’জনে ধরছে? স্কুল ভাঙার দারোয়ানরা ধরছে না?

রাব্বি : আমার নামটা দিও না, প্লিজ

বৃষ্টি : তোমার নাম দেব না, তুমি যেভাবে পার আমার ভাইকে ছুটাই দে। এখানে মানুষ জমা হয়ে যাচ্ছে। আমার খালা যাচ্ছে তো।

রাব্বি : খালা গিয়ে লাভ নেই তো। সোহেল ভাই আমার সঙ্গে দৌড় মারতে পারেনি। এজন্য ধরা খাইছে।

বৃষ্টি : ও যে হাবলা তুমি জান না? ভাই কখন আসবে বলো। এখানে মানুষ জমে যাচ্ছে। আমাদের এ এলাকার কোনো বেটা পুলিশ বেটাকে ফোন করছে। ভাই ভাই তাড়াতাড়ি কর। তুই আমারে মাইরা ফালাইলিরে… এরপর বৃষ্টির কাছ থেকে তার মা কোহিনূর বেগম ফোন নিয়ে নেয়।

মা : (কোহিনূর বেগম) : রাব্বি ‘লাশ ফেলতে দেখছিল কেউ’

রাব্বি : না, না, কেউ দেখে নাই। হ্যালো হ্যালো …

কথা হয় কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে লাশ ফেলার সময় স্থানীয় লোকজন সোহেলকে আটক করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে বাসায় অভিযান চালিয়ে নিহত তৈয়ব আলীর স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকাকে গ্রেফতার করেন তারা। এ ঘটনায় তৈয়ব আলীর ভাই জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন সদরঘাট থানায়। থানার ওসি মর্জিনা বেগম ঘাতক সোহেলের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, পরে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম