গ্যাসের দাম বাড়ার ঘোষণা আসছে বিকেলে

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে আজ রোববার বিকাল ৪টায় সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সেখানে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামসহ অন্যান্য কমিশনাররা উপস্থিত থাকবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দেয়া হয়। ‘এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কারণে এরই মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আরো ১৪ হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে না পারলে ভর্তুকি আরো বাড়বে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। আরো ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ হবে। গত বছর আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করেছি আমরা। এ গ্যাসের দাম অনেক বেশি। নিজস্ব গ্যাসেই আমরা এখন ভর্তুকি দেই। অনেক কম দামে গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করা হয়। যদি দাম সমন্বয় করা না হয় তবে চলতি অর্থবছরে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। আগামী অর্থবছর ৭-৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি লাগতে পারে।

আমরা বাসাবাড়িতে গ্যাস ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছি বলে জানান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা একটা বড় প্রকল্প নিয়েছি তাতে ঢাকা শহরসহ সব জায়গায় পুরনো গ্যাস লাইন উঠিয়ে নতুন লাইন করা হবে। সেখানে প্রিপেইড মিটার বসানো হবে। আমরা বলেছি জাইকার সহযোগিতায় যাতে শতভাগ প্রিপেইড মিটার করা যায়। এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী গ্যাসের সব মিটার দ্রুতই প্রিপেইড করার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন।

শিল্প ও গৃহস্থালি উভয় ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয় দিয়েছে জানিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সব জায়গায় কিছুটা হলেও সমন্বয় করার কথা বলেছি। এক প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা টার্গেট অনুযায়ী এগোচ্ছি। এবারও বিদ্যুৎ উৎপাদন টার্গেটের চেয়ে বেশি থাকবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০৪১ সালের প্ল্যানটা আমরা করে ফেলেছি। ভবিষ্যতের জন্য মাতারবাড়িতে ল্যান্ড বেজ টার্মিনাল এবং ল্যান্ড বেজ এলপিজি টার্মিনাল- দুটি পোর্ট হলে গ্যাসের দাম অনেক সাশ্রয়ী হবে।

আমরা এলপিজিও সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে দিতে পারব। এটা করতে সময় লাগবে। ৪-৫ বছর সময় লাগবে এ ধরনের ডিপ সি টার্মিনাল করতে। কোল টার্মিনাল করতে বেসরকারিভাবে জাপানের কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে জানিয়ে বিপু বলেন, ‘আমরা মাতারবাড়িতে একটি কোল টার্মিনাল করতে চাই। কয়লা এনে ওখানে রাখা হবে, ওখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় যাবে। এটা নির্মাণের ফিজিবিলিস্টি স্টাডি হয়েছে। মাতারবাড়িতে এক্সটেনশন প্রজেক্ট করার জন্য জাপান আরো দুই বিলিয়ন ডলার দেবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। বাসাবাড়িতে এক চুলার বর্তমান দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৪০ টাকা করার আবেদন করা হয়েছে।

একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, সিএনজি, সার, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এ নিয়ে গত মার্চে গণশুনানির আয়োজন করা হয়। বিইআরসি আইন অনুসারে শুনানির ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনকে সিদ্ধান্ত জানাতে হয়। জুনে সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে।

আইনে আরো উল্লেখ রয়েছে, কমিশন যদি মনে করে কোম্পানির কাছ থেকে আরও তথ্য নিতে হবে তাহলে সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে। তাই জুনে সময়সীমা ফুরালেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জুলাই মাসে নেয়া হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত বছরের জুনেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে গণশুনানি হয়েছে। কিন্তু সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় তখন দাম বাড়ানোয় সরকারের সাড়া মেলেনি। তাই গত ১৬ অক্টোবর সরকারকে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার সুপারিশ করে গ্যাসের দাম না বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি।

জ্বালানি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অনেক বেশি। আর দেশে গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। এ হিসাবে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করতে হলে সরকারকে আরো অনেক বেশি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। কাজেই গ্যাসের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে কোনো বিকল্প নেই।

পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, এতদিন আমদানি কম হওয়ায় সরকারের ওপর লোকসানের চাপ বেশি হয়নি। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এলএনজি আমদানিতে সম্পূরণ শুল্ক, কাস্টমস ডিউটি ও অগ্রিম বাণিজ্য ভ্যাট প্রত্যাহার করায় গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত ছিল। আমদানি ১০০০ এমএসিএফডি ছাড়ালে দাম বাড়ানোর তোড়জোড় আরও আগে থেকেই শুরু হতো।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের পর আগস্টে বাংলাদেশ এলএনজি যুগে প্রবেশ করে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে ওই টার্মিনালের মাধ্যমে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেয়া হচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে সর্বোচ্চ ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার টার্গেট ছিল সরকারের। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় সরকার এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিচ্ছে জাতীয় গ্রিডে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের এক সদস্য বলেন, তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে জুলাইয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। কমিশনের ওই সদস্য জানান, শুনানিতে পাওয়া মতামত যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হয়েছে।

দাম বাড়ানোর বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, গ্যাস খাতে লোকসান কমাতে হলে প্রথমে চুরি ঠেকাতে হবে। পাশাপাশি সাগর ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিতে হবে। দেশীয় গ্যাস পেলে কম টাকায় সরবরাহ করা যাবে। এলএনজি আমদানি করে গ্যাস-সংকট দূর করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। ওই বছরের মার্চ ও জুলাই থেকে তা দুই ধাপে কার্যকর হয়।

লেটেস্টবিডিনিউজ/এনপিবি

Scroll to Top