আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা তুলে ধরেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই পরিকল্পনা প্রস্তাবে সায় দিয়ে আরো কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি চলমান সংকট মোকাবেলায় সীমিত ঘাটতি রেখে অভ্যন্তরীণ আয় থেকে অর্থায়ন বাড়াতে জোর দিতে বলেছেন।
করের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে সরে না এসে বরং বাড়াতে হবে।
রাজস্ব বাড়াতে ক্ষেত্রবিশেষে আরো কর আরোপ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে নতুন করে আর কোনো কর অব্যাহতি না দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষি ও খাদ্যপণ্য এই দুটিতে ছাড় দিতে বলেছেন তিনি।
গণভবনে গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হওয়া বাজেটবিষয়ক সভায় এসব নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভ্যন্তরীণ আয় থেকে অর্থায়নের বিষয়ে রাজস্ব বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। এই বৈঠকে অর্থসচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস অনুবিভাগের নীতি শাখার সদস্য, প্রথম সচিব, দ্বিতীয় সচিব ও বাজেট প্রণয়নকারী দল অংশ নেয়।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলনে এনবিআরকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এনবিআর নতুন কর, ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনায় সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা যায়, আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে ভ্যাট থেকে এক লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, আয়কর এক লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং শুল্ক এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়োছিল চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব খাত সংস্কারের মাধ্যমে এনবিআরকে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। আগামী অর্থবছরের শর্ত পূরণ করতে হলে কর-জিডিপির অনুপাত ৮.৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব বাড়াতে বিভিন্ন খাতে কর আরোপের কৌশল নিচ্ছে এনবিআর।
প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা অনুযায়ী রূপরেখা প্রণয়ন করে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামবে এনবিআর, যাতে সরকারের সীমিত বাজেট ঘাটতি বেড়ে না যায়।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫টি নির্দিষ্ট পণ্য ও কিছু সেবার ক্ষেত্রে নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে। এর ফলে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে সব ধাপে ভ্যাটের হার হবে ১৫ শতাংশ। বর্তমানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভেদে ৩, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করে এনবিআর।
সূত্র জানায়, গতকাল বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দেয় এনবিআর। তবে প্রধানমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে সব পণ্য ও সেবার বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ না করে কিছু পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে পর্যায়ক্রমে একক ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেছেন তিনি।
এই ভ্যাট আরোপে ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয়ের চাপ বাড়বে।
ভ্যাটের অভিন্ন হারের মতো কর অব্যাহতিও ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের পরিকল্পনা এনবিআরের। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার ভ্যাটের আদর্শ হার ১৫ শতাংশ কার্যকর করার দিকে এগোচ্ছে। তবে আগামী অর্থবছরেই সব ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন হবে না। এর বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে হবে। এ ছাড়া কীটনাশকের ভ্যাট কমাতে এনবিআর প্রস্তাব দিলেও তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, মোবাইল ফোনের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবে ইতিবাচক সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে মোবাইলে কথা বলতে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তার। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৮৩ টাকার কথা বলতে পারে। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তারা ৭৮ টাকার কথা বলতে পারবে।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে প্রথমবার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রথমে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলেও বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে তা কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর দুই বছর পর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। পরে ২০১৯ সালে এটি ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করা হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলায় ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের এক শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়।





