খেলাপি ঋণের ৮৫ শতাংশই ২০ শাখায়

অবলোপনসহ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। এ ঋণের ৮৫ শতাংশই সৃষ্টি হয়েছে ২০টি শাখায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ শাখাগুলোর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এ শাখাগুলোর ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে খেলাপির শীর্ষে থাকা ২০টি শাখা মাত্র ২৪৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে। যদিও চলতি বছরে খেলাপি ঋণ থেকে এ শাখাগুলোর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত আট মাসে লক্ষ্যমাত্রার ৫ শতাংশও আদায় করতে পারেনি শাখাগুলো।

সারা দেশে সোনালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১ হাজার ২১০টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে রাজধানীর স্থানীয় কার্যালয়ে। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ২০ শাখার মধ্যে আরো আছে— হোটেল শেরাটন করপোরেট শাখা, রমনা করপোরেট শাখা, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা, খুলনা করপোরেট শাখা, নারায়ণগঞ্জের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করপোরেট শাখা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা, ঢাকার বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখা, চট্টগ্রামের লালদীঘি করপোরেট শাখা, খুলনার দৌলতপুর করপোরেট শাখা ও রাজধানীর শিল্প ভবন করপোরেট শাখা।

খেলাপি ঋণের দিক থেকে শীর্ষে থাকা ২০টি শাখার হিসাব বাদ দিলে সোনালী ব্যাংকের অবস্থা অনেক ভালো বলে দাবি করেন ব্যাংকটির নীতিনির্ধারকরা। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বণিক বার্তাকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২১০টি শাখার মধ্যে ৬০০ শাখায় খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশেরও কম। ২০টি শাখাতেই রয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৮৫ শতাংশ ও পাঁচটি শাখায় ৫৪ শতাংশ। এটা বাদ দিলে মোটের ওপর সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ খুব বেশি নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে, বড় শাখায় বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না।

সোনালী ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয়ে (লোকাল অফিস) ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ রয়েছে ৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হয়ে পড়ায় অবলোপন করা হয়েছে ১ হাজার ৫১ কোটি টাকার ঋণ। সে হিসাবে ব্যাংকটির স্থানীয় কার্যালয়ে মোট খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। চলতি বছরে খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে শাখাটির আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে গত আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে আদায় করেছে ১০৩ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে হোটেল শেরাটন করপোরেট শাখায়। অবলোপনসহ শাখাটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ১৪ কোটি এবং ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা অবলোপনকৃত। চলতি বছরে খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৬৯১ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত আট মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা।

তৃতীয় স্থানে থাকা রমনা করপোরেট শাখায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৭৫৩ কোটি ও অবলোপনকৃত ৭৪৭ কোটি টাকা। চলতি বছরে খেলাপিদের কাছ থেকে ৪৯৯ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মাত্র ১২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে শাখাটি।

খেলাপি ঋণের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা। শাখাটির মোট ১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। খেলাপিদের কাছ থেকে চলতি বছর ১৮৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গত আট মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৬ কোটি টাকা।

ঢাকার খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে শাখাগুলো ব্যর্থ হলেও কিছুটা সফলতা দেখিয়েছে খুলনা করপোরেট শাখা। তালিকায় পঞ্চম স্থানে থাকা শাখাটিতে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬৮৩ কোটি ও অবলোপনকৃত ঋণ ১২৮ কোটি টাকা। চলতি বছর ৪৪৯ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪৯ কোটি টাকা আদায় করেছে শাখাটি।

ষষ্ঠ স্থানে থাকা নারায়ণগঞ্জ ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ রয়েছে ৬১৬ কোটি টাকা। গত আট মাসে শাখাটি খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে মাত্র ৩ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। খেলাপির তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করপোরেট শাখার নাম। অবলোপনসহ শাখাটির ৫৫৪ কোটি টাকাই চলে গেছে খেলাপি ঋণের খাতায়। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে চলতি বছরের আট মাসে মাত্র ২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে শাখাটি।

অষ্টম স্থানে থাকা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখায় খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫০২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর পর রয়েছে চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখার নাম। শাখাটির ৫১৪ কোটি টাকা চলে গেছে খেলাপির খাতায়। তালিকার দশম স্থানে রয়েছে রাজধানীর বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখা। অবলোপনসহ শাখাটির ৫০২ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে।

খেলাপি ঋণের দিক থেকে শীর্ষ ২০ শাখার মধ্যে দৌলতপুর করপোরেট শাখায় ৪৭১ কোটি, শিল্প ভবন করপোরেট শাখায় ৪৬৭ কোটি, দৌলতপুর কলেজ রোড শাখায় ৩৪২ কোটি, দিলকুশা করপোরেট শাখায় ৩১৩ কোটি, ফরিদপুর করপোরেট শাখায় ১৮৮ কোটি, যশোর করপোরেট শাখায় ১০৫ কোটি, কক্সবাজার শাখায় ৯৬ কোটি, খুলনার খালিশপুর শাখায় ৯১ কোটি, গুলশান শাখায় ৬৬ কোটি এবং বিওয়াপদা করপোরেট শাখায় ৫৫ কোটি টাকা অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ রয়েছে ব্যাংকটির।

হল-মার্কসহ বড় বড় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আর্থিক বিপর্যয়ে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপির খাতায় যুক্ত হয়েছে ব্যাংকটির ১১ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ঋণ। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হয়ে পড়ায় একই সময়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সে হিসাবে জুন শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এ সময় সোনালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৩৩ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকই খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছে।

বড় খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় কঠিন হয়ে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ। তিনি বলেন, ছোট গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য মামলা করলে সফলতা আসছে। কিন্তু বড় ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। একের পর এক রিট করার কারণে বড় খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১০ সাল থেকে সোনালী ব্যাংকের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। অতীতে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্যোগের মধ্যেও আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছি।

বাংলাদেশ সময় : ১৩২০ ঘণ্টা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ