জবিতে প্রশ্নফাঁসে জড়িত শিক্ষকরাই!

রাকিবুল ইসলাম
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রশ্ন বিতরণে দ্বায়িত্বরত শিক্ষকদের অনৈতিকতার কারণেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষকরা প্রশ্ন বিতরণের নীতিমালা নিয়ে অবহেলা কিংবা কোনও রকম ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত কারণে হলেও ভেতরের প্রশ্ন যে শিক্ষকদের হাত থেকেই বাইরে ছড়িয়েছে, ফাঁস হয়েছে তাতে সন্দেহ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

গত শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) ‌’এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন জালিয়াতির অভিযোগে ৫ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভর্তি পরীক্ষা শেষে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রুনা লায়লা এ রায় দেন।

প্রশাসানিক সূত্রে জানা যায়, ভর্তি পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরেই মোবাইলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় প্রক্টরিয়াল বডি কি করছিল কিংবা তাদের দায়িত্বই বা কি ছিল জানতে চাইলে একাধিক শিক্ষক মোবাইলে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, প্রশ্ন নয়, শিক্ষার্থীরা তখন সাজেশন দেখছিল।

এসময় মোবাইলসহ ওই শিক্ষার্থীদের আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পড়ে অবশ্য মোবাইল রেখে পরীক্ষা দিতে দেয়া হয় তাদের। পরীক্ষা শেষে সাজেশনের সঙ্গে প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেলে পরীক্ষা বাতিল করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

মোবাইলসহ প্রশ্ন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীকে আটকের ঘটনা তুলে ধরে জবির সহকারী প্রক্টর বিভাষ কুমার সরকার বলেন, ‘তখন দুপুর আড়াইটা। এসময় কিছু শিক্ষার্থীকে দেখি ক্যাম্পাসে সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সামনে ঝাউগাছের পাশে বসে মোবাইলে কি যেন দেখছিল। আমি গিয়ে দেখি ভেতরে সাজেশন আকারে হাতে লেখা একটি প্রশ্ন পড়ছিল। তখন আমি মোবাইলটা নিয়ে নেই এবং বলি পরীক্ষা শেষে এসে দেখা করবা। পড়ে আমরা মূল প্রশ্নের সাথে এ প্রশ্নের হুবহু মিল খুঁজে পাই।’

এদিকে ঠিক একই সময়ে ‘এ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিতে মোবাইলসহ মূল গেইট অতিক্রম করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন প্রশ্ন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থী। তখন তিনি পরীক্ষা কেন্দ্রের এক পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে সাজেশন আকারে হাতে লেখা প্রশ্ন পড়ছিলেন। যেখানে মূল প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে হস্তান্তর হবার কথা ছিল পরীক্ষা শুরুর ঠিক ৫ মিনিট আগে, অর্থাৎ দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগেই শিক্ষার্থীর হাতে প্রশ্ন হস্তান্তর হলো কি করে। আর তখনই প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষকদের দায়ি করে কিছু কিছু অভিযোগ উঠা শুরু হয়। অথচ জগন্নাথের বাইরে ২৬টি কেন্দ্রের জন্য প্রশ্ন বিতরণের দ্বায়িত্বে ছিলেন ৩২ জন শিক্ষক। এদের সমন্বয়ক ছিলেন ৯০ জন এবং সহকারী সমন্বয়ক ছিলেন ১৭০ জন।

সার্বিক বিষয়ে ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট নিয়ম করা হয়েছে, দুপুর ২টা ৫৫ মিনিট থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে প্রশ্ন কেন্দ্রে হস্তান্তর করতে হবে। আমরা জগন্নাথ ক্যাম্পাস থেকে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ৩২ জন পরিদর্শকের হাতে প্রশ্ন দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠাই। কিন্তু যখন দুপুর আড়াইটায় একজন শিক্ষার্থীর কাছে হাতে লেখা প্রশ্ন পাওয়া যায় তখন সন্দেহের তালিকায় শিক্ষকরাই থাকার কথা। একটি হাতে লেখা প্রশ্ন মানে আড়াইটা নয়, আরও আগেও প্রশ্ন আউট হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলতে পারছি না কে বা কারা এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এতোটুকু আমরা সবাই জানি, একটি গ্রুপে সবাই খারাপ থাকেন না। দু’একজন দুষ্ট লোকের কারণে সবার অপমান হতে হয়। আমরা দিনরাত কষ্ট করে প্রশ্ন রেডি করি। এগুলো আগলে ধরে থাকি। কিন্তু আমাদের হাতের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর হেফজত ঠিকভাবে কেউ করে না।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্বার্শবর্তী কেন্দ্র বাংলাবাজার সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রেজাউল করিম এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় বের হয়েছিল দ্বায়িত্বরত প্রধান পরিদর্শকরা। যেমন, আমার কেন্দ্র পাশে থাকায় আমি ক্যাম্পাস থেকে আমার টিমসহ বের হয়েছিলাম ২টা ১০মিনিটে। আমরা সতর্কভাবেই প্রশ্ন নিয়ে কেন্দ্রে পৌঁছি।’

প্রশ্ন নিয়ে মূল কেন্দ্র থেকে বের হবার পর প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এটা ঠিক বলতে পারবো না। এ বিষয়ে আমি কোনও খোঁজখবরও নেইনি। বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন প্রধান সমন্বয়ক জাকারিয়া স্যার।’

এদিকে, যারা ইনভিজিলিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরও দুদিন আগে জানিয়ে দেয় ডিন অফিস। কিন্তু এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সময় অনেক শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকা স্বত্ত্বেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হননি। তাদের অনুপস্থিতির কারণে স্বয়ং ডিনরা ইনভিজিলেটরের দায়িত্ব পালন করেন। অথচ এসময় তাদের পুরো পরীক্ষার খোঁজখবর রাখার কথা ছিল। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভিজিলেটরের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুপস্থিত সকল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার তাৎক্ষণিক অভিযোগ উপাচার্য বরাবর তুলে ধরেছেন ‘এ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধাক সমন্বয়ক ও লাইফ এন্ড আর্থ সাইন্সের ডিন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া। তবে কতজন শিক্ষক দায়িত্ব পালনে অনুপস্থিত ছিল তা এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, ১৫ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/সাদ