SSC Pass

শত বাধা পেরিয়ে মনের জোরে জয়ী ওরা,নেই কলম ধরার হাতটিও

কেউ লড়াই করেছে নির্মম দারিদ্র্যের সঙ্গে। পরিবারের ছিল না বই-খাতা কেনার টাকা। রাতে পড়তে হয়েছে কুপির ম্লান আলোতে। কারো নেই কলম ধরার হাতটিও।

লিখতে হয়েছে পায়ের আঙুলে কলম চেপে ধরে। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা বাধা হয়ে উঠতে পারেনি তাদের সামনে। অদম্য মনোবলে সব বাধা ঠেলে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে ওরা। 

এই জীবনযুদ্ধের বিজয়ীরা হচ্ছে—

আশরাপি খাতুনের বাবা নুর আলম হতদরিদ্র দিনমজুর।

প্রতিদিন মেলে না কাজ। ১০ শতকের ভিটাবাড়ি ছাড়া কোনো সহায়- সম্পদ নেই। ছয়জনের সংসারে তাই নিত্য অভাব। চার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ঠিকমতো জোগাতে পারেন না অসহায় বাবা।
প্রয়োজনীয় সব বই ছিল না। ছিল খাতা-কলমের অভাব। বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ না থাকায় রাতে পড়াশোনা করেছে কুপির আলোতে। এত ‘নেই’-এর মধ্যে ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর ভালো ফল করার স্বপ্ন। আশরাপি তার কষ্টের সুফলও পেয়েছে।

পূরণ হয়েছে স্বপ্ন। এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে সে। তার এবারের স্বপ্ন ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার। কিভাবে এই স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত থাকবে তা অবশ্য জানে না সে।

গতকাল রবিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সন্ন্যাসী গ্রামে আশরাপির বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা নুর আলম দিনমজুরি করতে গেছেন ধরলার চরে। ভাঙা একটি চালাঘরে তাদের বসবাস। সেই ঘরে পরীক্ষার সাফল্য উদযাপনের কোনো আতিশয্য নেই। তবে জীর্ণ কুটিরে আলো ছড়াচ্ছিল আশরাপি নিজেই।

সাফল্যের কথা জানতে চাইলে আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে আশরাপি খাতুনের। কান্নাভেজা কণ্ঠে সে বলল, ‘কুপি বাতি পাশে রেখে বই নিয়ে রাত জেগে পড়েছি। ক্লাসে অনেকেই যখন পড়া না পারলে বিদ্যুৎ না থাকার অজুহাত দিত, আমি কোনো অজুুহাত দিতাম না। যত কষ্টই হোক পড়া তৈরি করে স্কুলে যেতাম।’

আশরাপির বাবা দরকারমতো খাতা কিনে দিতে না পারায় ভোটের পোস্টার জোগাড় করে এনে দিয়েছেন। তাই দিয়ে খাতা বানিয়ে সাদা ও ফাঁকা অংশে লিখত সে। প্রতিবেশী ও শিক্ষকরা কখনো কখনো বই-খাতা দিয়ে সহায়তা করেছেন। গত পাঁচ বছরে দুপুরে কোনোদিন টিফিন খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

এত বাধা পেরিয়ে সাফল্যের পেছনে মা-বাবা, শিক্ষক ও এলাকার দিশারী পাঠাগারের অবদানের কথা জানাল আশরাপি।

মা রাবেয়া খাতুন জানান, আশরাপি ছাড়াও তাঁর আরো তিন ছেলেমেয়ে আছে। মাত্র একজনের আয়েই খুব কষ্টে সংসার চলে।

আশরাপির বাবা নুর আলম জানান, প্রতিদিন কাজ মেলে না। তাই সংসারের ব্যয় ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দিতে কষ্ট হয়। কারো সহায়তা না পেলে মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে একদিন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন না তিনি।

পা দিয়ে লিখেছে সরিষাবাড়ীর সিয়াম

জন্ম থেকেই দুই হাত নেই জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের সিয়ামের। পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। পেয়েছে জিপিএ ৩.৮৩।

কেবল শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গেই নয়, সিয়ামকে লড়তে হয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গেও। তার বাবা জিন্না মিয়া সামান্য আয়ের একজন দিনমজুর। তবে অভাব অনটন আর হাত না থাকার সমস্যাকে পেছনে ফেলে মনোবলের জোরে এগিয়ে যেতে চায় সিয়াম।

সরিষাবাড়ী উপজেলার চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে সিয়াম। অভাবের কারণে পরিবারের ছোট সন্তান সিয়ামের পড়ালেখা প্রাথমিকের মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যালয় বেতন মওকুফ করলে আবার পড়ালেখা শুরু করে সে।

দুই হাত হারালেও সাহস হারায়নি রাব্বি

আট বছর আগে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যায় রফিকুল ইসলাম রাব্বির জীবনে। ভাটিয়ারী বাজারের একটি ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে পড়ে থাকা বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যায় সে। এতে তার দুই হাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণে বাঁচলেও দুটি হাতই কেটে ফেলতে হয়। পরিবারের লোকজন ধরেই নিয়েছিলেন তার আর লেখাপড়া করা হবে না। কিন্তু অদম্য মনোবলের রাব্বি দমে যায়নি।

প্রথমে মুখে এবং পরে পায়ের আঙুলে কলম ধরে লেখা আয়ত্ত করে রাব্বি। চালিয়ে যেতে থাকে লেখাপড়া। মুখ দিয়ে লিখে জেএসসি পরীক্ষা পাস করেছিল সে। এবার পা দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য পেল। রাব্বি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার দরিদ্র দিনমজুর বজলুর রহমানের ছেলে।

পড়ার খরচ জোগাতে টিউশনি

সংসারের অভাবের কারণে নবম শ্রেণি থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচের একাংশ জোগাতে হয়েছে আবদুর রহিমকে। তার পরও জিপিএ ৫ পেয়েছে সে। রহিম ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। তার লক্ষ্য সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে সংসারের অভাব ঘোচানোর পাশাপাশি দেশের সেবা করা।

ঝিকরগাছা উপজেলার সদর ইউনিয়নের লাউজানী মহাজেরপাড়ার মৃত ওসমান আলীর তিন ছেলের মধ্যে আবদুর রহিম মেজো। মা তসলিমা বেগম গৃহিণী। ওসমান আলী খিলি পান বেচতেন। অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার মধ্য দিয়ে তিন সন্তানকে বড় করার চেষ্টায় ছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। আবদুর রহিম জানিয়েছে, বদর উদ্দীন মুসলিম হাই (বিএম) স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ তার পড়ালেখার সব ব্যয় বহন করেন।

Scroll to Top