‘হ্যালো, এসেনসিয়াল ড্রাগস থেকে সিদ্দিকুর বলছি’

‘হ্যালো, এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি থেকে সিদ্দিকুর রহমান বলছি’—এমন মিষ্টি মধুর আন্তরিকতায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। কে এই সিদ্দিকুর রহমান?

তিনি এসেনসিয়াল ড্রাগসের প্রধান কার্যালয়ের অভ্যর্থনা কক্ষে টেলিফোন সেটের সামনে বসে থাকা ধোপদুরস্ত পোশাক পরা এক যুবক। বাইরে থেকে কল এলে তা মিষ্টি ভাষায় রিসিভ করেন। তারপর কলটি স্থানান্তর করে দেন কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগসের প্রধান কার্যালয়ের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে থাকতে দেখা যায় সিদ্দিকুরকে। চোখে কালো চশমা। মুখে সব সময় হাসি।

অথচ কথা শুনলে বোঝা যাবে না ২০ জুলাই এই যুবকের জীবনের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেদিন শাহবাগে আন্দোলনে গিয়ে

‘পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলের’ আঘাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ২১ বছর বয়সী সিদ্দিকুরের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই দিনই তাঁকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর দুই চোখে অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকেরা বলেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখের দৃষ্টি নেই। বাঁ চোখে এক দিক থেকে আলো ফেললে আলোর উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। দৃষ্টি ফেরার ‘ক্ষীণ’ আশা আছে। ২৭ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সিদ্দিকুরকে ভারতের চেন্নাইয়ে পাঠানো হয়।

চেন্নাইয়ে অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকেরা সিদ্দিকুরের দৃষ্টি ফিরবে না বলে মত দেন। দেশে ফেরার পর ১৩ সেপ্টেম্বর সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ১৩ হাজার টাকা বেতনের সঙ্গে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও পাবেন তিনি। এক বছর পর চাকরি স্থায়ী হলে বেতন হবে ২৩ হাজার টাকা।

মাত্র আড়াই মাসে জীবনের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়-ঝাপ্টা মুছে ফেলে ২ অক্টোবর চাকরিতে যোগ দেন সিদ্দিকুর রহমান। অল্প সময়েই সহকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এখানকার সবাই আন্তরিক। ভাগ্য আমার সহায় ছিল। তাই চাকরি পেয়েছি। আমাদের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নিজে খোঁজ নিচ্ছেন।’

নিজের পেশাগত কাজ রপ্ত করে ফেলার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়ে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সবার আন্তরিকতার জন্য কাজ দ্রুত শিখতে পারছি। আমি কল দিতে পারি, রিসিভ করতে পারি। তবে ফোন এলে ট্রান্সফার করার কাজটি আরও শিখতে হবে।’

সিদ্দিকুর রহমানের সহকর্মী সজল খান বলেন, ছেলেটি ভীষণ মেধাবী। আসলে ও তো হঠাৎ করেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। ফোনের বটমগুলোর কোনটিতে কোন নম্বর সেটা সিদ্দিক রপ্ত করে ফেলেছে। আঙুলের ছোঁয়াতেই সেটি বুঝতে পারে। তবে ওর জন্য উপযোগী উন্নত প্রযুক্তির ফোনসেটের সন্ধান করছি। এটি পেলে সিদ্দিকুরের কাজ করতে সুবিধা হবে।’

তবে চাকরি পেয়েই জীবনযুদ্ধে থেমে যেতে চান না সিদ্দিকুর রহমান। পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সিদ্দিকুর বলেন, ‘অনার্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার ভাগনে মহাখালী থেকে তেজগাঁওয়ের অফিসে নিয়ে আসে। ওর সঙ্গেই ফিরে যাই। বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করছি।’

সিদ্দিকুরের সহকর্মীরা জানান, মাত্র আট টাকায় সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার অফিস থেকেই খেতে পান তাঁরা। ক্যানটিনে সবার সঙ্গে বসে সিদ্দিক খাবার খেয়ে থাকেন। অফিসের কাছাকাছি কোনো এলাকায় সিদ্দিকুরের জন্য বাসাও খোঁজা হচ্ছে।

সিদ্দিকুরের কাজকর্ম ও ব্যবহারে মুগ্ধ এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এহসানুল কবির জগলুল। তিনি বলেন, ‘ফোনসেটের ডিজিট ও নিজেই খুঁজে বের করতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, সিদ্দিকুর এখনো কাগজ-কলম পেলে লিখতে পারে। এ ধরনের চাকরি ছেলেটির জন্য উপযুক্ত। এই কাজে কথা বলতে পারবে এবং শুনতে পারবে সিদ্দিকুর।’

এক বছর পর সিদ্দিকুরের চাকরি স্থায়ী হবে। এই সময়ের আগে এই চাকরি স্থায়ী করার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে এহসানুল কবির বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ চাকরি স্থায়ী করতে পারবে। এর চেয়ারম্যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আমি বোর্ড সভায় বিষয়টি তুলে ধরব।’

বাংলাদেশ সময় : ১৪৩৫ ঘণ্টা, ০৫ অক্টোবর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ