কেন সুমাইয়ারা বাঁচতে পারেন না?

ঢাবির প্রাক্তন ছাত্রী সুমাইয়া মারা গেছেন। সুমাইয়ার পরিবারের দাবি, তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যা করেছেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির কাছে সুমাইয়া একটি স্বাধীন সত্তা হওয়ার অপরাধে অপরাধী ছিলেন, যে সত্তা স্বপ্ন দেখত স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচার। সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির মানুষজন সুমাইয়ার লেখাপড়া ও চাকরির ইচ্ছা মেনে নিতে পারছিলেন না।

ছয় মাস আগেও তাঁকে একবার ঘরে আটকে রেখে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, বারবার পড়াশোনার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাবার সহযোগিতা আর নিজের ইচ্ছায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অবশেষে একদিন হার মানেন নিয়তির কাছে। প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সুমাইয়াকে অন্যের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হতে হয়। জীবনের রথ হঠাৎ থেমে যায় সুমাইয়ার।

তবে সুমাইয়ার মতো অপরাধে অপরাধী নারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয় আমাদের সমাজে। কত শত সুমাইয়ার স্বপ্ন ঝরে পড়ে অকালে। ঝরে পড়া স্বপ্ন নিয়ে অতৃপ্ত অনেক সুমাইয়াই তাঁদের পার্থিব জীবন শেষ করেন। আমরা কয়জন তাঁদের কথা মনে রাখি! স্বপ্নপূরণের যাত্রায় সব কুল বজায় রাখতে পারেন, এমন সৌভাগ্যময় নারীর সংখ্যা খুবই কম। আর যেসব আত্মপ্রত্যয়ী নারী স্বপ্নপূরণের যাত্রায় অনমনীয় অবস্থান নেন, পরিবার আর সমাজের চোখে তঁারা বেশির ভাগই অপরাধী, স্বার্থপর। সুমাইয়ার মৃত্যুসংবাদটি প্রচারিত হয়েছিল বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে।

সংবাদের লিংকে থাকা পাঠকের মন্তব্যগুলো আমি গভীর মনোযোগসহকারে পড়েছি। সেই মন্তব্যগুলো সত্যিকার অর্থে প্রতিফলন ঘটায় নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকেই আপত্তিকর ভাষায় আঙুল তুলেছেন সুমাইয়ার দিকেই। কারণ, বিয়ের পর তিনি তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সিদ্ধান্তকে মেনে নেননি। বাবার মৃত্যুর পর সুমাইয়ার লড়াইটা ছিল একান্তই তাঁর একার।

তিনি কাউকেই পাশে পাননি। সুমাইয়া সে লড়াইয়ে হেরে গেছেন। একা একা যুদ্ধে জেতা যে বড় কঠিন কাজ! প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত অনেককেই বলতে শুনি, ‘কেউ কখনো কাউকে ক্ষমতায়িত করতে পারে না; যতক্ষণ না সে নিজেই নিজেকে ক্ষমতায়িত করে।’ প্রশ্ন হলো, বাবার মৃত্যুর পর সুমাইয়া তো আত্মক্ষমতায়নের পথেই হাঁটছিলেন। তবে কেন থমকে গেল তঁার জীবনের পথচলা! আর শুধু সুমাইয়ার কথা বলছি কেন; স্বপ্নপূরণের ব্যর্থতা নিয়ে জীবন পার করা কিংবা অন্যের ইচ্ছার বলি হয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া নারীর সংখ্যা তো নিতান্ত কম নয়
আমাদের চারপাশে।

আমরা চাই, দ্রুত সুমাইয়ার মৃত্যুর তদন্ত হোক এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু অন্যায়কারীর সাজা নিশ্চিত করলেই এ ধরনের চলমান অপরাধের প্রতিকার হবে না। বরং সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সমস্যার মূলে কাজ করা। এ ধরনের ঘটনায় কিন্তু শুধু সুমাইয়াদের জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে না; বরং এ ধরনের অত্যাচারী হওয়ার প্রবণতা অপরাধীদের জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে। সুমাইয়ার স্বামী পেশায় একজন প্রকৌশলী। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতরা কেন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছেন, তা–ও তলিয়ে দেখতে হবে। এই যে শুরুতে পাঠকের মন্তব্যের কথা বললাম, সেই মন্তব্যগুলো কিন্তু সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক একটি শ্রেণির বিশ্বাস থেকে উৎসারিত।

সেই সমাজ যুগে যুগে পুরুষকে শিখিয়েছে পৌরুষ–সম্পর্কিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা, কিছু মিথ। যেমন প্রকৃত পুরুষ হতে হলে তাকে হতে হবে নিয়ন্ত্রণকারী, সমস্যা সমাধানের নায়ক। তাকে হতে হবে নির্ভীক, তেজস্বী, ক্ষমতাশালী, ঝুঁকি গ্রহণে সক্ষম এ রকম কত–কী! পুরুষ জেনেছে আবেগের বাহুল্য প্রকাশ তার জন্য অবমাননাকর। পুরুষ বোঝে না, প্রকৃত পুরুষ হওয়ার তথাকথিত এই মানদণ্ড বজায় রাখতে তাদেরও অনেকের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এ মানদণ্ড অর্জনের প্রক্রিয়ায় দিনে দিনে তাদের কারও কারও মধ্যে বেড়ে ওঠে আবেগ–অনুভূতিবর্জিত চরম অত্যাচারী এক সত্তা। এই সত্তা সব সময় নিজেকে উচ্চ আসনে দেখতে ভালোবাসে। নিজের অধিকার ধরে রাখার প্রয়াসে প্রয়োজনে খুনি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না তারা।

তাই এখন সময় এসেছে অত্যাচারীর দিকে বেশি মনোনিবেশ করার। সামাজিক যে কাঠামোগুলো এবং সংস্কারগুলো একজন মানুষকে অত্যাচারী হতে শেখায়, তার মূলে কাজ করা প্রয়োজন। অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে চাই সমন্বিত কার্যক্রম। মনে রাখতে হবে, পুরুষেরাও কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির শিকার। এর ফল শুধু নারী নয়, পুরুষের জন্যও ভয়াবহ। এ ব্যবস্থায় পুরুষেরাও নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা তারা অনেক ক্ষেত্রে তলিয়েও দেখে না। পুরুষতান্ত্রিক এই চর্চা একজন পুরুষের জন্য যে কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ, তা বোঝানোর ক্ষেত্রে এত দিন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি আমরা।

একটি পরিবারের যাবতীয় অর্থনৈতিক দায়ভার একজন পুরুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা বোঝাতে পারিনি যে সুমাইয়াদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও ক্ষমতায়ন তার স্বামীর জীবনও সহজ সাবলীল করে তুলতে পারে। নারী-পুরুষের যুগল শক্তি তাদের করে তুলতে পারে অধিকতর আত্মবিশ্বাসী। পরিবারে পুরুষ এবং নারীর ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সুখী দাম্পত্যজীবনের অন্যতম মূলমন্ত্র। লকডাউনের মধ্যে চাকরি হারানো অনেক পুরুষকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্ন রকম স্ট্যাটাস দিতে দেখেছি। স্ট্যাটাসে তাঁরা তাঁদের নতুন উপলব্ধির কথা বলেছেন। আয়–উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক পুরুষ স্বীকার করেছেন নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তার কথা! কারণ, এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে হয়তো পুরুষটির উপার্জন বন্ধ আছে, কিন্তু নারীটির উপার্জন অব্যাহত আছে।

নিজেদের স্বার্থেই পুরুষের জন্য নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সমর্থন করা জরুরি। নারীর পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থানকে মেনে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে না নিতে পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে বরং আজকের নারীর সঙ্গে মানিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।