আগে দুবার ধর্ষণ করা হয় নোয়াখালীর ওই নারীকে

দেশে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের মত জঘন্য ঘটনা হঠাৎ বেড়ে গেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় এখলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ আরো দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এ ঘটনায় ছয়জন আটক হয়েছেন। এদিকে ঘটনা তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গঠিত কমিটি জানিয়েছে, ওই নারীকে র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া দেলোয়ার হোসেন এক বছর আগে একবার ধর্ষণ করেন। এরপর তাঁর বাহিনীও একবার তাঁকে ধর্ষণ করে। ভয়ের কারণে দেলোয়ারের নাম প্রকাশ করেননি তিনি।

ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার প্রধান আসামি র‌্যাবের হাতে ধৃত বাদলকে গতকাল সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন বেগমগঞ্জের বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালত। ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র বিচার বিভাগীয় হাকিম ফাহমিদা খাতুনের আদালত র‌্যাবের অভিযানে নারায়ণগঞ্জ থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেলোয়ার হোসেনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অস্ত্র আইনে র‌্যাবের করা মামলায় এই রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া মানবাধিকার কমিশনের দুজন প্রতিনিধি আল মাহমুদ ফজলুল কবির ও গাজী সালাউদ্দিন নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলেন।

সোমবার রাতে মামলার পাঁচ নম্বর আসামি সাজুকে (২১) ঢাকার শাহবাগ থেকে এবং স্থানীয় ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে (৪৮) একলাসপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সাজু একলাসপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের লোকমানের ছেলে; সোহাগ একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এবং মৃত হাজি গোলাম মোস্তফার ছেলে। বেগমগঞ্জ থানার ওসি মো. হারুন উর রশীদ জানান, আদালতে ভিকটিমের জবানবন্দি অনুসারে ইউপি সদস্যকে ২২ ধারায় আটক করা হয়েছে।

ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে নির্যাতিতা গৃহবধূ (৩৫) গত সোমবার রাতে বাদী হয়ে ৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো সাত-আটজনকে আসামি করে দুটি মামলা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র‌্যাব তিন দফায় অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করেছে। র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ আটক সন্ত্রাসী ও নির্যাতনের পরিকল্পনাকারী দেলোয়ার হোসেনকে এ দুটি মামলাতেই গ্রেপ্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার ১০ দিনের রিমান্ডের জন্য বেগমগঞ্জ বিচার বিভাগীয় আদালতে মঙ্গলবার বিকেলে আবেদন করেছে বেগমগঞ্জ থানার পুলিশ।

নিরাপত্তাহীনতায় মূলহোতার নাম প্রকাশ করেননি নির্যাতিতা: মানবাধিকার কমিশন গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আল মাহমুদ ফজলুল কবির বলেন, নিরাপত্তাহীনতায় ও ভয়ের কারণে ঘটনার মূলহোতা দেলোয়ারের নাম প্রকাশ করেননি ওই গৃহবধূ। দুপুরে জেলা মানবাধিকার কমিশনের দুই সদস্যের প্রতিনিধি জেলা শহরে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মিলনায়তনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন।

কমিশনের সদস্যরা জানান, দেলোয়ার তাঁকে ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করেন এবং ঘটনা প্রকাশ করলে তাঁদের কাছে থাকা ভিডিওগুলো ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেবেন বলে হুমকি দেন। ফজলুল কবির বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করব।’ তিনি বলেন, নির্যাতিতা তাঁকে জানিয়েছেন, এক বছর আগে দেলোয়ার তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর বাহিনী ভয় দেখিয়ে একবার তাঁকে নৌকায় নিয়ে ধর্ষণ করেছে।

কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেছেন, একলাসপুরে বাড়িতে ঢুকে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে যার যার সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে আসামির তালিকাভুক্ত করা হবে। অপরাধীদের কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। সব আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি মঙ্গলবার সকালে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা মামলার বাদী নির্যাতনের শিকার ওই নারীর সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদের সংবাদ সম্মেলন
ওই নারীকে নির্যাতনের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নোয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ কিরন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কেউ গৃহবধূকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকলে তদন্ত করে দলীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অব্যাহত
বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণসহ দেশব্যাপী নারী-শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল মঙ্গলবারও উত্তাল ছিল নোয়াখালী। সকালে নোয়াখালী প্রেস ক্লাব, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনের সড়ক ও মাইজদী প্রধান সড়ক বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে উত্তাল হয়ে ওঠে। জেলা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ‘জেলা যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক’। বিকেলে জেলা শহরে ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা।

জেলা যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক জানায়, পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর মাসে নোয়াখালীতে ধর্ষণ একটি, গণধর্ষণ একটি, ধর্ষণচেষ্টা তিনটি, উত্ত্যক্ত সইতে না পেরে আত্মহত্যাসহ আত্মহত্যা দুটি, নারী হত্যা দুটি এবং দুজন নারীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। মানববন্ধন শেষে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জেলা শহর মাইজদীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।