নিম্নমানের বিটুমিনে ‘সিন্ডিকেট’, সক্রিয় ১৯ মাফিয়া গোষ্ঠী

দেশে নিম্নমানের ও ভেজাল মিশ্রিত বিটুমিনের বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে ভয়ংকর ১৯ মাফিয়া গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। ‘বিটুমিন সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত এই মাফিয়া গোষ্ঠীর কারণে বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে আবর্জনাতুল্য বিটুমিন।

আর দেশে আসার পর অধিক মুনাফার জন্য সেগুলোতে মেশানো হয় ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক।

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এলাকা চট্টগ্রামকে একরকম ‘হেডকোয়ার্টার’ বানিয়ে চালানো হচ্ছে এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এতটাই ভয়ংকর ও প্রভাবশালী যে, একরকম ‘ওপেন সিক্রেট’ এই সিন্ডিকেটের নাম কেউ মুখেও আনতে চায় না।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ বিটুমিনের প্রয়োজন হয়। তবে এর মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় দেশেই; প্রায় পুরোটাই উৎপাদন করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। বিটুমিনের বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাকি অংশ আমদানি করা হয় দেশের বাইরে থেকে।

চাহিদা ও দেশীয় উৎপাদনের এই বৈষম্যকেই কাজ লাগাচ্ছে বিটুমিন সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিকভাবে নিষেধাজ্ঞায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে ওই সিন্ডিকেট। পণ্য খালাসের আগে সেগুলো কোনো ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়েই যায় না। আর সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করছে ১৯ মাফিয়ার সিন্ডিকেট।

এমনকি আমদানি করা বিটুমিনের গুণগত মান সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। কোনো এক ‘গায়েবী’ হাতে সেসব তথ্য নেই করে দেয় সেই মাফিয়া সিন্ডিকেট।

যোগাযোগ ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা বিটুমিন দেশে প্রবেশের আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ইআরএলের মাধ্যমে পরীক্ষা করে আসছেন।

এমন দাবি জানান, সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা অনেক সৎ ব্যবসায়ীরাও। কিন্তু সরেজমিন তদন্ত বলছে, বন্দরে এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে, দীর্ঘদিনের এই দাবি বাস্তবায়নে এখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর এটা সম্ভব করছে বিভিন্ন ধাপে হাতবদল হওয়া অন্তত ৫০ কোটি টাকা।

তবে আমদানি করা বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা জানান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কমিশনের সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমরা আমদানি হওয়া বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণ করি। কোথাও নিম্নমান ও ভেজাল মেশানোর অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

শুধু আমদানি করেই ক্ষান্ত হয় না সিন্ডিকেট বরং আমদানির পরেও চলে ভেজাল মেশানোর ‘মিশন’। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থেকে বাড়ৈয়ারহাটে এলাকায় ৮ থেকে ১০টি মিলে বিটুমিনের ড্রামে ভেজাল মেশানো হয়। ফেনী থেকে মিরসরাইতে কয়েকটি স্থানে বিটুমিনে ভেজাল মেশানো হয় প্রকাশ্যে। এসব মিলে বিটুমিনের সঙ্গে মাটি, বালু মিশিয়ে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এই সবকিছুই হয় ‘সিন্ডিকেট’ এর নিয়ন্ত্রণে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আমদানি করা বিটুমিন একে তো নিম্নমানের তার উপর এটিকে ব্যবহারের আগে বারংবার তাপ দেওয়া হয়। ফলে গুণগত মান হারানো পাতলা হয়ে আসা বিটুমিনকে উন্নত ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের ভুয়া রূপ দিতে এতে ভেজাল হিসেবে যোগ করা হয় ‘গিলনোসাইড’, মাটি ইত্যাদি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের থেকে সস্তা দামে বিটুমিন আমদানি করা হচ্ছে। অসাধু ঠিকাদাররাও নিম্নমানের এ বিটুমিন লুফে নিচ্ছেন কারণ এতে অধিক মুনাফা। আমদানি করা বিটুমিন জাহাজে তোলার আগে একবার হিট দেওয়া হয়, জাহাজ থেকে নামানোর পর একবার এবং ড্রামে ভরার সময় আরও একবার হিট দেওয়া হয়। এতে বিটুমিন পাতলা হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তখন এর সঙ্গে আবার ভেজাল মিশিয়ে এটাকে আসল গ্রেডের মতো দেখানো হয়। এর বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) সহকারী ড. নাজমুস সাকিব বলেন, আমদানি করা নিম্নমানের ও ভেজাল মেশানো বিটুমিন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে কারণ এগুলোতে খরচ কম। কিন্তু মূলত এগুলো আসলে আবর্জনা আর সেই আবর্জনা দিয়ে দেশের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করা হচ্ছে। ফলে কোন রোডের লাইফটাইম যদি তিন বছর হয়, দেখা যায় সেটি এক বছরেই বা এক বর্ষা মৌসুম ঘুরতেই নষ্ট হয়ে যায়।

দেশের সড়ক-মহাসড়ক উন্নত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে বিটুমিন ব্যবহার নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপণে বিটুমিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইআরএলের বিটুমিন ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। সেটি পাওয়া না গেলে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এই প্রজ্ঞাপণ মানার বালাই দেখা যায় না। বিপিসি ও ইআরএলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০ সালে করোনার কারণে অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজ দীর্ঘসময় স্থবির থাকায় বিটুমিনের ভালো মজুদ থেকে যায় ইআরএলের। তবে, ঠিকাদারদের সেগুলো কেনার থেকে আমদানি করা নিম্নমানের ও ভেজাল বিটুমিনেই বেশি আগ্রহী দেখা যায়। একপর্যায়ে, বিটুমিনের দাম কমাতে পর্যন্ত বাধ্য হয় ইআরএল।

দেশীয় বিটুমিনের বদলে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ থেকে আনা নিম্নমানের বিটুমিনের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ড্রাম ভর্তি করে এসব বিটুমিন দেশে এনে গলিয়ে বাল্কে বিক্রি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের তদারকি আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

** অবাধে আমদানি হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের বিটুমিন

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দুই জায়গায় এবং নোয়াখালীতে প্রকাশ্যে সড়কের কাছে ড্রামে করে আমদানি করা নিম্নমানের বিটুমিন গলানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে ড. নাজমুস সাকিব বলেন, এই বিটুমিনগুলো কোথা থেকে এসেছে, কি উপায়ে উৎপাদন করা হয়েছে কিছুই আমরা জানি না। তবুও আমরা সেগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছি অথচ দেশেই উন্নতমানের বিটুমিন তৈরি হচ্ছে এবং আরও তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত এই আমদানি করা বিটুমিনের দিকে কঠোর নজরদারি করা। বিটুমিন যদিও আমদানি করেও আনা হয় সেটি যেন আমাদের জানা সোর্স থেকে আনা হয়, দেশের বাজারে আসার আগে সেগুলোর যেন পরীক্ষা হয় এবং বাজারে এসে সেগুলোতে যেন আবার ভেজাল মেশানো না যায়। এরজন্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে।

:বাংলানিউজ