পটকা মাছ খেলে মৃত্যু হয় যে কারণে

পটকা মাছ বাংলাদেশের নদীতে সচরাচর পাওয়া যায়। এর সামুদ্রিক জ্ঞাতির নাম বেলুন মাছ। পটকা মাছের ৪টি বৈজ্ঞানিক নাম আছে যথা টেট্রোডন প্যাটোকা, শেলোনোডন প্যাটোকা, টেট্রোডন ডিসুটিডেনস্‌, এবং টেট্রোডন কাপ্পা।

এর দেহ প্রায় গোলাকার, মাথা চওড়া, দেহখণ্ডও চওড়া তবে লেজের ঠিক পূর্বে হঠাৎ সরু হয়ে গেছে। উপরিতল থেকে সামান্য নিচে মুখ, উভয় মাড়ীতে দুটি ছেদন দন্ত রয়েছে। এই ৪টি দাঁতের কারণেই এর বৈজ্ঞানিক নামে “টেট্রাডন” শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। এ মাছ খেলে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।

দেশে পটকা মাছ খেয়ে মৃত্যুর মিছিল ক্রমে বাড়ছে। সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের পটকা মাছ থেকে একই পরিবারের দুই সদস্যের মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও দরিদ্রতাই মূলত এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কী কারণে পটকা মাছ বিষাক্ত এবং কেনই বা এই মাছটি খাদ্যতালিকা থেকে চিরতরে বয়কট করা উচিত- এ ব্যাপারে পক্ষ থেকে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামছুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের পটকা মাছ পাওয়া যায়। স্বাদুপানির পটকা ও লোনাপানির পটকা। স্বাদুপানির পটকা আকারে লোনাপানির পটকার চেয়ে অনেক ছোট। আমাদের স্বাদুপানিতে দুই প্রজাতির পটকা (Tetrodon cutcutia এবং Chelenodon patoca) পাওয়া যায়। উভয় প্রজাতির পটকাই কম-বেশি বিষাক্ত।

Chelonodon
অন্য দেশের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পটকা মাছ (সামুদ্রিক) জাপানে একটি দামি, সুস্বাদু ও অভিজাত শ্রেণির মাছ হিসেবে পরিচিত। পটকা মাছ তাদের ঐতিহ্যের অংশ। জাপানিরা বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে তাদের পটকার কোন প্রজাতি কোন সময় বিষাক্ত তা ইতোমধ্যে জেনে গেছে। পটকার মেন্যু তৈরির জন্য তাদের রয়েছে লাইসেন্সধারী বিশেষ শেফ। তবুও পটকা মাছ খেয়ে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন, মেক্সিকো ইত্যাদি দেশেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যদিও সে সংখ্যা এখন একেবারেই হাতেগোনা।

বিষাক্ততার তারতম্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মৌসুমে পটকা মাছ অধিক বিষ বহন করে। পটকার চামড়া ও গোনাডে সাধারণত অধিক বিষ থাকে। পটকা মাছের বিষাক্ততা অঙ্গ, প্রজাতি, স্থান ও ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে পটকা মাছের যে প্রজাতিটি মারাত্মক বিষাক্ত জাপানে সেটা ততটা বিষাক্ত নাও হতে পারে। অনুরূপভাবে, বৈশাখ মাসে যে পটকা মাছটি বিষাক্ত, কার্তিক মাসে তাতে ততটা বিষ নাও থাকতে পারে। তাই অপেক্ষাকৃত কম বিষ ধারণ করা সময়ে পটকা মাছ খেয়ে ভোক্তার হয়তো কোনোরূপ দুর্ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু অজ্ঞতাবশত অধিক বিষ বহনকালে একই পটকা খেয়ে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এলাকাভেদে বিষাক্ততার তারতম্যের জন্যেও একই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির পটকায় বিষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামুদ্রিক পটকার ক্ষেত্রে (Tetrodotoxin, TTX বহনকারী) মানুষের জন্য বিষাক্ততার মাত্রা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ১০ মাউস ইউনিট (MU, বিষাক্ততার একক) অর্থাৎ, পটকার প্রতি ১ গ্রাম অংশে যদি ১০ MU বিষ থাকে তবে তা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এ পরিমাণ বিষ খেলে তার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং এভাবে যদি একসঙ্গে ১০ হাজার MU বিষ একজন সুস্থ-সবল মানুষ খেয়ে ফেলে তবে নির্ঘাত মৃত্যু। একইভাবে স্বাদুপানির পটকার ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে ৩ MU বিষ (Saxitoxin, STX) থাকলে তা বিষাক্ত এবং ৩ হাজার MU একসঙ্গে খেলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে সামুদ্রিক পটকার চেয়ে স্বাদুপানির পটকা অধিকতর বিষাক্ত। উপরন্তু, পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনটি কোন সময়ে বিষাক্ত এ ধরনের যথেষ্ঠ তথ্য আমাদের জানা নেই। স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু তাও আমরা জানি না। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে পটকা মাছ খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকাই উত্তম।
Saltwater Chelonodon

অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামছুজ্জামান আরো বলেন, পটকা মাছের বিষ সায়ানাইড (Cyanide) এর চেয়েও অধিকতর বিষাক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোনো সামুদ্রিক পটকা প্রতি গ্রামে ৪০০০ MU পর্যন্ত বিষ (TTX) বহন করে। অর্থাৎ, একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তি এরূপ বিষাক্ত পটকার ৩ গ্রাম খেলেই বিষাক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। অনেকের ধারণা, পটকা মাছ রান্না করলে এর বিষাক্ততা নষ্ট হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অত্যধিক তাপে বিষের উপাদান (Chemical Structure) এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে, কিন্তু এতে বিষাক্ততার খুব একটা তারতম্য হয় না।

রোগীর দেহে বিষক্রিয়া প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. মোস্তফা বলেন, স্বাদুপানি ও লোনাপানির পটকার বিষাক্ততার লক্ষণ রোগীর দেহে প্রায় একইরকম। পটকা মাছের বিষকে Neurotoxin কিংবা Sodium channel blocker বলা হয়। পটকা মাছের বিষ (TTX; m.w. 319) মানবদেহের নার্ভ সেলের Voltage-gated sodium ion channel এর সাথে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। ফলে হার্টে সোডিয়াম প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এতে মানবদেহে ইলেকট্রোলইটিক্যাল ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। বিষাক্ততায় এক ঘণ্টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে রোগীর ঠোঁট ও জিহবায় জড়তা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, মুখে শুষ্কতা, মাংসপেশীতে ব্যথা ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে থাকে। পরিণামে ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুও হতে পারে। তাই রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে স্থানীয় হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে এবং চিকিৎসা নিতে হবে।

এতিহাসিকভাবে এটাকে গাঙ্গেয় জলজ প্রাণী হিসাবেই বর্ণনা করা হয়। পটকা মাছের বিষাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অদ্যাবধি কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে পটকা মাছ খাওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। তবে এর দামি বিষ আইসোলেট করে আমরা তা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি বলে জানান সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামছুজ্জামান।