জিভে জল আনা বাংলাদেশের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার ও তার ইতিহাস (পর্ব ০২)

ঐতিহ্যগত খাদ্য বা ঐতিহ্যবাহী খাবার বলা হয় সেই সব খাবারকে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরে সম জনপ্রিয়তায় টিকে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী সভ্যতার উপর এসব ঐতিহ্যময়ী খাবারের একটি দৃঢ় প্রভাব থাকে। জাতীয় খাবার, আঞ্চলিক রন্ধণশৈলী কিংবা স্থানীয় খাবারগুলোর অনেকগুলোই ঐতিহ্যগত খাবারের ঐতিহাসিক নজির। ঐতিহ্যগত খাবারসমূহ বাড়িতে বানানো হয়, রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় কিংবা বৃহৎ পরিসরে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানায় উৎপাদন করা হয়।

১/ ভাঁপা পিঠাঃ
Vapa Pitha
ভাঁপা পিঠা বাংলাদেশ ও ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা। যা প্রধানত শীত মৌসুমে প্রস্তুত ও খাওয়া হয়। এটি প্রধানত চালের গুঁড়া দিয়ে জলীয় বাষ্পের আঁচে তৈরী করা হয়। মিষ্টি করার জন্য দেয়া হয় গুড়। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য নারকেলের শাঁস দেয়া হয়।

ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি গ্রামীণ নাশতা হলেও বিংশ শতকের শেষভাগে প্রধানত শহরে আসা গ্রামীণ মানুষদের খাদ্য হিসাবে এটি শহরে বহুল প্রচলিত হয়েছে। রাস্তাঘাটে এমনকী রেস্তোরাঁতে আজকাল ভাঁপা পিঠা পাওয়া যায়। এই পিঠা অনেক অঞ্চলে ধুপি নামেও পরিচিত। এর ধরণের মধ্যে রয়েছে মিষ্টি ভাপা ও ঝাল ভাপা।

২/ বগুড়ার দইঃ
Bogurar Doi
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সব খাবারের মতো বগুড়ার দই যেকোনো প্রান্তে এক নামে যে কেউ চেনেন। সারাদেশে এর সুনাম আজ অবধি রয়েছে। বগুড়ার দই এখন ঢাকায় পাওয়া যায়। তবে স্বাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দইয়ের প্রসার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এত বেশি ব্র্যান্ড চলে এসেছে যে বাইরের কেউ সহজে আসল বগুড়ার দই চিনতে ভুল করেন, ফলে অনেকেরই বগুড়ার দই নিয়ে ভুল ধারণা চলে আসে।

বগুড়ার মিষ্টি ব্যবসায়ী দেবাশীষ ঘোষ জানান, বগুড়ার দই নকলের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন বহু ব্র্যান্ড আছে এগুলোর কোনটা আসল আর কোনটা নকল তা বোঝা দায়।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আসল দইয়ের প্রতিষ্ঠান হলো : হোটেল আকবরিয়ার দই, হোটেল শ্যামলীর দই, সেলিম হোটেলের দই, রফাতের দই, মহররম আলীর দই, বগুড়া দইঘরের দই, বগুড়া দইঘরের দই, গৌরিগোপাল দধি ভাণ্ডারের দই-এগুলোই বেশ নামকরা। তার পরও সংশয়ে থাকতে হয় এটা আসল দই তো? দেশের প্রসিদ্ধ সব মিষ্টি দ্রব্যাদির জায়গায় এখন নকলের হাট বসেছে। এর মধ্য দিয়েই টিকে আছে দেশময় প্রসিদ্ধ বগুড়ার দই।

৩/ পুরান ঢাকার বাকরখানিঃ
Puran Dhakar Bakhorkhani
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। খাবারের ধরনে এসেছে আধুনিকতা। যা কখনো কখনো ইতিবাচক, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। তবে অঞ্চল ও খাবারের স্বাদ ভেদে এখনো অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার টিকে আছে। পুরান ঢাকার বাকরখানি এর মধ্যে অন্যতম। প্রায় আড়াই শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক এ বাকরখানি আর কাপভর্তি চায়ের মাধ্যমেই জেগে ওঠে পুরান ঢাকাবাসী। এত বছর পুরনো হয়েছে সত্য, তবে বাকরখানির চাহিদা কমেনি বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এমনকি আধুনিক সময়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাকরখানি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। পুরান ঢাকার বিখ্যাত এই বাকরখানি আজ যাচ্ছে কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

পুরান ঢাকার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই বাকরখানি তৈরির পেছনে রয়েছে এক অমর প্রেমকাহিনী। এর নামকরণের গল্পটা বেশ দারুণ। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। তখনকার বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ সুদর্শন এ বালককে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারেই বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় যাকে আমরা এখন বরিশাল নামে চিনি। আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্ব্বী ছিলেন কোতয়াল জয়নুল খাঁ।

এই নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই দ্বন্দ্বের কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাকেরকে এক বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। শক্তিধর বাকের বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরের মতো বেরিয়ে এসেছিলেন। ততক্ষণে খনি বেগমকে অপহরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের গহীনে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধারে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন বাকেরখনি।

পুরান ঢাকার প্রখ্যাত লেখক নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে এ কথা। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা আজ বাকরখানি হয়ে গেছে। নবাবদের এই খাবার বাকরখানি তৈরি হতো মালাই-মাখন দিয়ে অতীতে ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামির তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। সে সময় এটা ছিল নবাব আর আমিরদের প্রিয় খাবার। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর তৈরি হয় না। তবে ঢাকার অনেক পুরনো খানদানি পরিবার বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগাম অর্ডার দিলে মালাই-মাখনের বাকরখানি এখনো সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আগে ঢাকার বনেদি পরিবার নিজেদের বাড়িতেই বাকরখানি তৈরির আয়োজন করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে দুধের মালাইয়ের পরিবর্তে বাকরখানিতে ডালডা ও তেল ব্যবহারের প্রচলন হয়। এটি তৈরির জন্য প্রথমেই একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি এবং ডালডার সমন্বয়ে খামির তৈরি করা হয়। এবার তৈরিকৃত খামির থেকে কেটে ছোট ছোট গোলাকার কোয়া তৈরি করা হয়।

এবার বেলুন দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে কোয়াটি দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এবার এর একপাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। আবার ঘি দিয়েও বিশেষ যত্নের সঙ্গে এই বাকরখানি তৈরি করা হয়ে থাকে। নোনতা, কাবাব, ছানা, পনির, চিনি, কিমা ও নারিকেলের সংমিশ্রণেও তৈরি করা যায় বাকরখানি। এ ছাড়া গরু ও খাসির মাংস দিয়েও এক ধরনের বাকরখানি তৈরি করা যায়। এই ধরনের বাকরখানি সাধারণত ঈদের সময় স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হয়।

নোনতা বাকরখানি সাধারণত ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়। লালবাগ কেল্লার কাছেই প্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে উঠেছিল। এরপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, আগা নবাব দেউড়ি, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, হাজারীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকায় বিস্তার লাভ করে। পুরনো ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের দুই পাশেও রয়েছে বাকরখানির অনেক দোকান।

এসব দোকানের বাকরখানি স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশানসহ রাজধানীর এলাকার সাধারণ দোকানে ও ডিপার্টমেন্ট স্টোরে সরবরাহ করা হয়। বাকরখানি চায়ের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন পুরান ঢাকায় বেশি। এ ছাড়াও গরু, খাসি, মুরগির মাংসের সঙ্গেও বাকরখানির স্বাদ অতুলনীয়। অনেক জায়গায় ক্ষীর ও পায়েসের সঙ্গেও পরিবেশন করা হয় বাকরখানি। বাকরখানি মূলত কেজি দরে বিক্রি করা হয়। ৩৫ থেকে ৪০টি বাকরখানি প্রতি কেজিতে পাওয়া যায়। প্রতি কেজির মূল্য ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।

৪/ কুমিল্লার রসমালাইঃ
Comillar rosmalai
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো ‘ভোগ’ বা রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ক্ষীরভোগ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ রসমালাই নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে মাতৃভান্ডার নামে দোকানে ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত এই রসমালাই বিক্রি শুরু হয়। খনিন্দ্র সেন ও মণিন্দ্র সেন নামের দুই ভাই রসমলাই তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে রসমালাইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। হয়ে ওঠে কুমিল্লার ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমানে এ মাতৃভান্ডার পরিচালনা করেন শংকর সেন।

দিনে দিনে এই রসমালাইয়ের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান এবং মিষ্টিপ্রিয় মানুষের কাছে রসমালাই এক প্রিয় নাম হয়ে ওঠে। মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, ১৯৯৮ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেলা পরিক্রমা অনুষ্ঠানে কুমিল্লার অন্যান্য ঐতিহ্য দেখানোর পাশাপাশি মাতৃভান্ডারের রসমালাইও দেখানো হয়। এরপর সারা দেশে রসমালাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। গত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আপ্যায়ন করা হয় এই রসমালাই দিয়ে। আর কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননি এমন ঘটনা বিরল।

কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমলাই এর নাম শুনলেই জিভে জল এসে যায়। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা থেকেই। তাই আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে যেকোনো জায়গার হলে চলবে না, আসল স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে কুমিল্লাতেই। কুমিল্লার সেই ঐতিহ্যবাহি মাতৃভান্ডারে। আসল মাতৃভান্ডার ছাড়া কুমিল্লার রসমালাই পাওয়া যাবে ভগবতি পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, পোড়াবাড়ি, জলযোগসহ কয়েকটি মিষ্টি দোকানে।

কুমিল্লার যত খ্যাতি তার সঙ্গে খাদি বস্ত্রের পাশাপাশি চলে আসে রসমালাইয়ের নাম। কুমিল্লায় এলে রসমালাই না নিয়ে ফেরার মানেই হয় না।

তবে আসল রসমলাইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে পেতে হবে আসল জিনিস। কারণ কুমিল্লা শহরকে ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল যে রসমলাই, তার স্বাদ অনেকেই পান না। সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই দিতে পারবেন যদি চিনে নিয়ে ঠিক ঠিক জায়গা থেকে আসল জিনিসটা কিনতে পারেন। কুমিল্লার বিখ্যাত এই রসমলাই পেতে আপনাকে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের কুমিল্লা মাতৃভান্ডাার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এইখান থেকেই অমৃত এই রসমলাই যাত্রা শুরু করেছিল।

প্রতিষ্ঠাতা: খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন
১৯৩০ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খড়িয়ালার খনিন্দ্র সেন ও মনিন্দ্র সেন নামে দুই ভাই কুমিল্লায় এসে শহরের মনোহরপুর এলাকায় মাতৃভান্ডার নামে একটি দোকান দিয়ে ক্ষীরভোগ বা রসমালাই বিক্রি শুরু করেন। সুস্বাধু হওয়ায় এ বিক্রি বাড়তে থাকে। এক সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। খনিন্দ্র সেনের এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে শংকর সেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারা গেছেন। ছোট মেয়ের নাম স্মৃতি সেন। মনিন্দ্র সেন বিয়ের করেন নি। ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেন মারা গেলে একমাত্র ছেলে শংকর সেন মাতৃভান্ডার পরিচালনা করা শুরু করেন। তিনিও এখন বয়সের ভাড়ে নূহ্য।

শংকর সেন জানান, বাবা ওয়াপদার চাকুরি ছেড়ে মাতৃভান্ডার মিষ্টি দোকানটি দেন। এটি মূলত মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবার বানানো রসমালাই পাকিস্তান আমল থেকে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আমার বাবা খনিন্দ্র সেনই প্রথম রসমালাই বিক্রি শুরু করেন।

মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস জানান, মাতৃভান্ডার নামে এ মিষ্টি দোকান প্রতিষ্ঠিার পর তাদের আর পেছনে তাকাতে হয় নি। তিনি জানান, বর্তমানে তাদের দোকানে উত্তম দে এবং ক্ষিতিষ মোদক নামে দুই জন অভিজ্ঞ কারিগর এই রসমালাই তৈরি করছেন। তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্মের কারিগররা রসমালাই তৈরি শিখে নিচ্ছেন।

৫/ কিশোরগঞ্জের বালিশ মিষ্টিঃ
Kishoreganjer balish misti
বালিশ মিষ্টি বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এটি আকারে বালিশের মত বড় না হলেও দেখতে অনেকটা বালিশের মত, এবং এর উপরে ক্ষীরের প্রলেপ থাকাতে একটি আবরণীসমেত বালিশের মত দেখায়। এই মিষ্টি গয়ানাথের বালিশ নামেও পরিচিত।

বালিশ মিষ্টির ইতিহাসঃ বালিশ মিষ্টির জনক গয়ানাথ ঘোষাল। হিন্দুদের মধ্যে ঘোষ পরিবার মিষ্টি তৈরিতে বিখ্যাত। নেত্রকোণা শহরের বারহাট্টা রোডের ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষ শত বছরেরও বেশি সময় আগে বালিশ মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। গয়ানাথের স্বপ্ন ছিল নতুন কোন ধরনের মিষ্টি আবিষ্কার করা।

একদিন তিনি বিশাল সাইজের একটি মিষ্টি তৈরি করলেন এবং ক্রেতাদের খেতে দিলেন এবং ক্রেতারা খুব প্রশংসা করলো। এর আকার অনেকটা কোল বালিশের মতো।

তাই ক্রেতাদের পরামর্শে মিষ্টিটির নাম রাখেন বালিশ। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বালিশের নাম। এর উদ্ভাবক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান গয়ানাথ ঘোষও। তাই এক সময় তার নামটিও জড়িয়ে যায় বালিশের সঙ্গে। লোকমুখে বালিশের নাম হয়ে ওঠে ‘গয়ানাথের বালিশ’। সে সময়ে শুধু তার দোকানেই এই মিষ্টি বিক্রি হতো। কিন্তু এখন তার দোকান ছাড়াও অন্যান্য দোকানেও বিক্রি হয় বালিশ মিষ্টি।

৬/ চট্টগ্রামের মেজবানঃ
Chattogramer mejhban
মেজবান বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি ভোজের অনুষ্ঠান। ফারসি মেজবান শব্দের অর্থ অতিথি আপ্যায়নকারী এবং মেজবানি শব্দের অর্থ আতিথেয়তা বা মেহমানদারি। চট্টগ্রামের ভাষায় একে মেজ্জান বলা হয়।

কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা, জন্মদিবস উপলক্ষে, ব্যক্তিগত সাফল্য, নতুন কোনো ব্যবসা আরম্ভ, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, পরিবারে আকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্ম, বিবাহ, খৎনা, মেয়েদের কান ছেদন এবং ধর্মীয় ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করা হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়।

ঐতিহাসিকভাবে মেজবানি একটি ঐতিহ্যগত আঞ্চলিক উৎসব যেখানে অতিথিদের সাদা ভাত এবং গরুর মাংস খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। মেজবান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ সাধারণত প্রতিবেশীদের এবং আশপাশের লোকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে শহরাঞ্চলে নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে অতিথিদের মাঝে বিলি করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে মেজবানি অনুষ্ঠান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে, তবে আনধুনিক কালে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্তও ভোজনের উৎসব চলত দেখা যায়।

মেজবানের বুৎপত্তি এবং ইতিহাসঃ
Mejhban
মেজবান ফারসি শব্দ। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। চট্টগ্রামের ভাষায় একে মেজ্জান বলা হয়। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবানি জেয়াফত নামে বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও বিভিন্ন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করা হয়। তবে মেজবানি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত।

এই অঞ্চলে পূর্বে হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা টিনের চুঙ্গি ফুঁকিয়ে মেজবানির নিমন্ত্রণ প্রচার করা হতো। মেজবানের উৎপত্তির সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় না। তবে এই প্রথা সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। মেজবান বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকেরা অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

রীতিঃ বর্তমানের সাথে অতীতের মেজবান অনুষ্ঠানের কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পূর্বে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে ও মাটির সানকিতে (থালা/পাত্র) আমন্ত্রিতদের খাবারের ব্যবস্থা করা হত। তবে বর্তমানে দুপুরে বা রাতে টেবিল চেয়ার ও সাধারণভাবে প্রচলিত থালায় খাবারের আয়োজন করা হয়।

খাদ্যঃ মেজবানে প্রধানত সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল (চট্টগ্রামের ভাষায় “নলা কাজি” বলা হয়) ও বুটের ডাল পরিবেশন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মাছ ও মুরগির মাংসও পরিবেশন করতে দেখা যায়। মেজবানের গরুর মাংসের স্বাদ এর খ্যাতির কারণ। মেজবানে রান্নার একটি বিশিষ্ট শৈলী রয়েছে যেখানে সঠিকভাবে মেজবানি মাংসেরে পরিমানের একটি নির্দিষ্ট দক্ষতা দাবি করে।

উদাহরণস্বরূপ:

১/ মরিচ ও মসলা সহযোগে রান্না করা ঝাল গরুর মাংশ।

২/ গরুর নলা দিয়ে কম ঝাল, মসলাটক সহযোগে রান্না করা শুরুয়া বা কাঁজি, যা নিহারী কাঁজি নামে পরিচিত।

৩/ মাষকলাই ভেজে খোসা ছাড়িয়ে ঢেঁকিতে বা মেশিনে গুড়ো করে এক ধরনের ডাল রান্না করা হয় যাকে ঘুনা বা ভুনা ডাল বলে।

৪/ কলাই ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে (উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে হলব্বু নামে পরিচিত) গরুর হাঁড়, চর্বি ও মাংস দিয়ে হালকা ঝালযুক্ত খাবার তৈরি করা হয়।

উদযাপনঃ বাংলাদেশে মেজবানি বর্তমানে জনপ্রিয় রান্না। রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু হয় ষাটের দশকের শেষে, জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর নূরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকার সভাপতি (১৯৬৮-৮৩) হবার পর। বাংলাদেশের সিলেট, খুলনাসহ দেশের বাইরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ও ইউরোপ, আমেরিকায় মেজবান পরিচিতি লাভ করেছে।