পুরনো ধাঁচেই নতুন সংসদ

দায়িত্ব পালনে ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার শপথ নিয়েছেন সদ্যসমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা সংসদ সদস্যরা (এমপি)। একইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করার অঙ্গীকার করেন তারা। জাতীয় সংসদের শপথ কক্ষে গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় তাদের শপথবাক্য পাঠ করান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর আগে নিয়মানুযায়ী স্পিকার নিজে নিজেই শপথ গ্রহণ করেন।

এবারের নতুন সংসদ সাজছে পুরনো ধাঁচেই। নব-নির্বাচিত ২৯৮ জন সংসদ সদস্যদের মধ্যে ২০৩ জনই আগের সংসদের (একাদশ জাতীয় সংসদ) সদস্য ছিলেন। এছাড়া দ্বাদশ সংসদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আগের সংসদেরই স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংসদ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা, উপনেতা হিসেবে মতিয়া চৌধুরী এবং চিফ হুইপ হিসেবে নূর-ই-আলম চৌধুরীই থাকছেন এবারও। ফলে নতুন কয়েকজন সদস্য ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ পুরনোদের নিয়েই যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।

ছয় দফায় শপথ অনুষ্ঠান: প্রথম দফায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিজেই নিজের শপথ নেন। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ এবং তৃতীয় ধাপে তাদের শরিক দলগুলোর এমপিরা শপথগ্রহণ করেন। চতুর্থ ধাপে জাতীয় পার্টির এমপিরা এবং পঞ্চম ধাপে স্বতন্ত্র এমপিরা শপথ নেন। আর বিকালে ষষ্ঠ ধাপে শপথ নেন সংসদের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র থেকে বিজয়ী হয়ে আসা এমপি ড. আওলাদ হোসেন। ফল স্থগিত করার কারণে সকালে তার শপথ হয়নি। পরে ড. আওলাদ হোসেন চেম্বার আদালতের রায় নিয়ে আসলে বিকালে তার শপথ পড়ানো হয়। আওয়ামী লীগ এমপিদের শপথে প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডান পাশে ছিলেন ওবায়দুল কাদের ও আমির হোসেন আমু এবং বাম পাশে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী, শাজাহান খান, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, শেখ হেলাল উদ্দীন ও আবদুর রাজ্জাক।

অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাসহ দ্বাদশ সংসদের এমপিরা নিজ নিজ নাম উচ্চারণ করে স্পিকারের সঙ্গে সঙ্গে শপথবাক্য পাঠ করেন। লিখিত শপথ অনুযায়ী তারা বলেন, ‘সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; এবং সংসদ-সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দেব না।’ এরপর সবাই শপথপত্রে নিজেদের আসনের নাম লিখে সই করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংসদ সচিব এ কে এম আবদুস সালাম। শপথগ্রহণ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে সংসদের ভিআইপি ক্যাফেটেরিয়ায় নতুন এমপিদের জন্য চা-চক্রের আয়োজন করা হয়।

নিয়মানুযায়ী, সংসদ নেতা নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রীর শপথের পর তার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠাবেন স্পিকার। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন আহ্বান করবেন। জানা গেছে, আগামী ২৮ কিংবা ৩০ জানুয়ারি এই অধিবেশন আহ্বান করা হতে পারে। অধিবেশনের শুরুতেই নতুন সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন হবে।

স্পিকার, সংসদ নেতা, উপনেতা, চিফ হুইপ একাদশেরই: দ্বাদশ জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে একাদশ সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকেই নির্বাচিত করা হয়েছে। সংসদ ভবনে গতকাল অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় বর্তমান স্পিকারকে আবারো স্পিকার হিসেবে নির্বাচন করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি। এদিকে সংসদীয় দলের সভায় সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সংসদ নেতা নির্বাচনের পাশাপাশি সংসদ উপনেতাও নির্বাচিত করা হয়েছে। একাদশে জাতীয় সংসদের উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরীকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও উপনেতা নির্বাচিত করা হয়। এছাড়া একাদশের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। লিটন চৌধুরী আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সবমিলিয়ে নতুন সংসদ অনেকটা পুরনো ধাঁচেই ফিরছে।

২৯৮ এমপির ২০৩ জনই আগের সংসদের: টানা চতুর্থবারের মতো জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ঘোষিত ২৯৮টি আসনের মধ্যে দলটির ২২২ জন নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে মাত্র ৪৬ জন প্রথমবার জাতীয় সংসদে যাচ্ছেন। বাকি ১৭৬ জনই আগের সংসদের সদস্য। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল থেকেও পুরনোরাই এসেছেন। বেশ কয়েকজন পুরনো এমপি এসেছেন স্বতন্ত্র থেকেও। সবমিলিয়ে ২০৩ জন এমপি একাদশ সংসদেরও সদস্য ছিলেন। ফলে একাদশের সদস্যদের দখলেই থাকছে দ্বাদশ সংসদ।

ছাড় দেয়া আসনেও পুরনোরা: আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও শরিকদের ৩২টি আসনে ছাড় দিয়েছিল। এরমধ্যে ১৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন তারা। এই ১৩ জনই আগের সংসদের সদস্য। বাকি ১৯ আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এদের মধ্যেও আবার অনেকে একাদশ সংসদে ছিলেন। এসব আসনে নতুন ১৭ মুখ হচ্ছেন কামারুল আরেফিন (কুষ্টিয়া-২), আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার (গাইবান্ধা-১), মহিউদ্দিন মহারাজ (পিরোজপুর-২)। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আলোচিত আরো রয়েছেন ব্যবসায়ী এ কে আজাদ (ফরিদপুর-৩) ও ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন (হবিগঞ্জ-৪)।

আওয়ামী লীগে ৪৬ জন নতুন মুখ: আওয়ামী লীগ থেকে ৪৬ জন নতুন মুখের মধ্যে আছেন মাগুরা-১ আসন থেকে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ঢাকা-১০ আসনের চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ। এছাড়া জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো পা রাখছেন মাজহারুল ইসলাম সুজন (ঠাকুরগাঁও-২), গালিবুর রহমান শরীফ (পাবনা-৪), মুহিত উর রহমান শান্ত (ময়মনসিংহ-৪), সোলায়মান সেলিম (ঢাকা-৭), ময়েজ উদ্দিন শরীফ (হবিগঞ্জ-২) এবং এস এম আল মামুন (চট্টগ্রাম-৪)। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের জামাতা তৌহিদুজ্জামান তুহিন যশোর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে পা রাখছেন জান্নাত আরা হেনরী। এছাড়া এস এম কামাল হোসেন (খুলনা-৩), শফিউল আলম চৌধুরী (মৌলভীবাজার-২), সেলিম মাহমুদ (চাঁদপুর-১), আবদুস সবুর (কুমিল্লা-১), সাঈদ খোকন (ঢাকা-৬), এম বদিউজ্জামান সোহাগ (বাগেরহাট-৪), বিপ্লব হাসান পলাশ (কুড়িগ্রাম-৪), আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিম (ফেনী-১), আবুল কালাম আজাদ (জামালপুর-৫) প্রথমবারের মতো সংসদে এসেছেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সুলতানা নাদিরা (বরগুনা-১), রুমানা আলী টুসি (গাজীপুর-৩), খাদিজাতুল আনোয়ার সনি (চট্টগ্রাম-২) আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এবং তাহমিনা বেগম (মাদারীপুর-৩), আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া (হবিগঞ্জ-১) স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টির আশরাফুজ্জামানও (সাতক্ষীরা-২) প্রথমবারের মতো সংসদে পা রাখছেন।

প্রথমবার এমপি প্রথমবার বাবা হওয়ার মতো: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম (হাতঘড়ি)। ইব্রাহিম শপথ নিতে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রথমবার এমপি হওয়া প্রথমবার পিতা হওয়ার মতো ভালো লাগছে। গতকাল বুধবার সকালে শপথ নেয়ার আগে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর শুকরিয়া, ভোটারদের প্রতি ধন্যবাদ। প্রথমবারের মতো এমপি হয়েছেন। কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমবার এমপি হলে ভালোই লাগে। প্রথমবার পিতা হবার মতো।’ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। তার প্রাপ্ত ভোট ৮১ হাজার ৯৫৫। পরাজিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম (ট্রাক গাড়ি)। তার প্রাপ্ত ভোট ৫২ হাজার ৯৮৬।

Scroll to Top