জাপানের সর্বপ্রথম মসজিদ

জাপান আমাদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাদি প্রস্তুতকারী একটি বড় দেশ হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু আমাদের মাঝে ক’জন আছে যে জাপানে ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানদের সংখ্যা এবং মসজিদ সম্পর্কে খবর রাখে! অনেকে হয়তো জানেই না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধ করে দেয়া হলেও আজ সে দেশে লক্ষাধিক মুসলমানের বসবাস। তন্মধ্যে ১০ শতাংশ মূল জাপানি বংশোদ্ভূত।

জাপানে ইসলামের ইতিহাস নতুন নয়। চায়নিজ ও ব্রিটিশ লেখকদের বই থেকে ইসলাম সম্পর্কে তাদের জানাশোনা। ১৮৮৬ এর দিকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বস্তুত সে সময় তুরস্ক একটি জাহাজ প্রেরণ করেছিল জাপান অভিমুখে। ফেরার পথে জাপানের কাছেই জাহাজটি ডুবে গেল। তখন বেঁচে যাওয়া লোকদের উদ্ধার করে জাপান তাদের তুরস্কে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এভাবে মুসলমানদের সঙ্গে জাপানের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেখানে ইসলাম ছড়িয়ে যেতে শুরু করল। যুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন মুসলিম দেশে অবস্থান করছিল; তারা সেখানে ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বস্তুত ওমর বোকেনা নামের একজন সেনাপ্রধান জাপান ফিরে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এরপর থেকে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। তাছাড়া চায়নিজ মুসলিমদের জাপানে হিজরত করাও সে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অনেক ভূমিকা রেখেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই কোরআন ও অন্যান্য ইসলামী গ্রন্থ জাপানি ভাষায় অনূদিত হতে থাকে এবং মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এগুলোও জাপানে ইসলাম প্রচারে অনেক অবদান রেখে চলেছে।

জাপানে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদটির রয়েছে এক দুর্লভ কাহিনী। এটি ‘কোবে মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধ। বস্তুত মসজিদটি কোবে শহরে অবস্থিত। কোবে জাপানের ষষ্ঠ বৃহত্তম নগরী। এটি হনশো দ্বীপের দক্ষিণদিকে এবং অকাসা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যময় একটি নগরী।

জাপানে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের মুসলমান, বিশেষত ভারতীয় ক’জন নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীর প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে এ কোবে মসজিদ নির্মিত হয়। কোবে মুসলিম সেন্টার নামেও এর বেশ পরিচিতি রয়েছে। মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে কাজ চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণকাজ পূর্ণতা লাভ করে। তুরস্কের নির্মাণকৌশল অবলম্বনে নির্মিত মসজদটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে পরিণত হয়।

সে বছরের ২ আগস্ট শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত নামাজ শুরু হয়। যেহেতু সময়টা ছিল গরমের, এ জন্য তারা শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন এবং ১১ অক্টোবর স্থানীয় অমুসলিম বাসিন্দাদের মসজিদ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। সেই অনুষ্ঠানে ৬ শতাধিক জাপানি উপস্থিত হয়েছিলেন। কোবে শহরের মেয়র মিস্টার গিনজিরো কাটসোদা ওইদিন তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আশা রাখি যে, মসজিদটি এখানকার মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে সহাবস্থান, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি, সর্বোপরি একটি শান্ত-শৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণে অশেষ ভূমিকা রেখে চলবে।’ সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি মসজিদটি ইতিহাসের একটি বিরাট ডকুমেন্ট ও সাক্ষী হয়ে আছে। বস্তুত এটি জাপানের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪৫ সালে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী পুরো কোবে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। শহরের সবগুলো দালান ও স্থাপত্যকে তারা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, কোবে শহরের এ মসজিদটি নিজ মহিমায় টিকে ছিল। শুধু কাচের কয়েকটি জানালা ও কিছু আস্তর খসে পড়েছিল। সে সময় আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর এমন বর্বরতা ও আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য জাপানের যোদ্ধারা এ মসজিদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। মসজিদ ছাড়া লুকানোর মতো তাদের কোনো বিকল্প ছিল না। এভাবে মসজিদটি সব জাতির মানুষের জন্য আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।

মসজিদটির দুর্লভ ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি নয়। ১৯৯৫ সালে জাপানে যে ভূমিকম্প হয়েছিল; বড় হেনশিন বা কোবে ভূমিকম্প নামক ওই দুর্যোগকে জাপানের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়Ñ সেই ভূমিকম্পে আশপাশের সবগুলো বিল্ডিং মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও এ মসজিদ স্বস্থানে নিরাপদে বহাল থাকে। যার কারণে আজও জাপানিরা এ মসজিদটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ১৭ অক্টোবর    ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসপি