কোরআনের হেদায়েত লাভের পাঁচ শর্ত

কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘এটি মোত্তাকিদের জন্য হেদায়েত।’ (সূরা বাকারা : ২)। কোরআন থেকে কেউ হেদায়েত পায়, কেউ গোমরা হয়। কোরআন থেকে হেদায়েত পাওয়ার রয়েছে কিছু পূর্বশর্ত। যথা-

প্রথম, তলব ও অনুপ্রেরণা থাকা

যার মধ্যে তলব ও অনুপ্রেরণা নেই, সে কখনও কোরআন থেকে হেদায়েত লাভ করতে পারবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালার শাশ্বত ও চিরন্তন বিধান, যার মধ্যে হেদায়েত লাভের তলব ও অনুপ্রেরণা থাকে, তাকেই তিনি হেদায়েত দিয়ে থাকেন। এ সম্পর্কে তিনি পবিত্র কালামে এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকেই তিনি পথপ্রদর্শন করেন।’ (সূরা শূরা : ১৩)।

তলব ও অনুপ্রেরণা থাকার কারণেই পরাধীন গোলাম হওয়া সত্ত্বেও বিলাল (রা.) এর ভাগ্যে হেদায়েত নসিব হয়েছিল। মনিবের প্রহারে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া, ক্ষুৎপিয়াসে কাতরানো, প্রচ- রোদে চিৎ করে শুইয়ে পাথর চাপা দিয়ে রাখা, কোনো কিছুই তাকে হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে হেদায়েত লাভ করার তলব ও অনুপ্রেরণা না থাকায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও আবু জাহেল, আবু তালেব, আবু লাহাবের ভাগ্যে হেদায়েত নসিব হয়নি। অথচ তাদের হেদায়েতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। তাদের অন্তিম মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) বেকারার হয়ে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে শষ্যার পাশে উপস্থিত হয়েছিলেন। সর্বোপরি তারা ছিলেন ওই পরিবারের সদস্য, যে পরিবার থেকে হেদায়েতের সূর্য উদিত হয়েছে।

তেমনি ওমর (রা.) যদিও আগে দ্বীনের দাওয়াত ও কোরআনের বাণী অনেকবার শুনেছিলেন। কিন্তু তার দিলের বন্ধদ্বার খোলেনি। তার ভাগ্যে হেদায়েত নসিব হয়নি। তিনি যখন বোনের রক্তমাখা শরীর দেখে অনুশোচনায় বিগলিত হন। বোন কী পড়ছিলেন, তা জানার জন্য তার দিলে তলব সৃষ্টি হয়। অতঃপর, তিনি সে তলব নিয়ে কোরআন পড়তে শুরু করেন, তখন তার দিলের বন্ধদ্বার খুলে যায়। তিনি হেদায়েত লাভে ধন্য হন। অতএব, যে ব্যক্তি হেদায়েত গ্রহণে সম্মত নয়, কেউ তাকে কিছুতেই সতর্ক করতে পারবে না। তাই আল্লাহ তাঁর রাসুলকে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে রাসুল আপনি যাকে চান তাকে পথ ্রদর্শন করতে পারবেন না, বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে পথপ্রদর্শন করেন।’ (সূরা কাসাস : ৫৬)।

দ্বিতীয়, অন্তর পাক-পবিত্র করা

কোরআনুল করিম থেকে হেদায়েত লাভ করতে হলে অহংকার-গর্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদি আত্মার ব্যাধি থেকে আত্মাকে পবিত্র করতে হবে। যেমন চাষি যদি ক্ষেতে বীজ বপন করার ইচ্ছা করে, তাহলে সর্বপ্রথম তাকে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। চাষি যদি আগাছা পরিষ্কার করে, বীজ বপন করে তবেই তাতে সোনার ফসল ফলে। পক্ষান্তরে চাষি যদি আগাছা পরিষ্কার না করেই বীজ বপন করে, তাহলে তাতে কোনো ফসল হয় না; বরং আরও আগাছা বেড়ে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা তার মধ্যে রূপকগুলোর অনুসরণ করে ফেতনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে।’

(সূরা আলে ইমরান : ৭)। অতএব, কারও অন্তর যদি অহংকার-গর্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ইত্যাদি আত্মব্যাধি থেকে পবিত্র না হয়, তাহলে সে কোরআনের আয়াতের মধ্যে বক্রতা অনুসন্ধান করবে, ফলে সে কোরআন থেকে হেদায়েত লাভ করতে পারবে না।

তৃতীয়, অন্তরে আল্লাহর বড়ত্বের অনুভূতি জাগরূক থাকা

আল্লাহ তায়ালা কত মহা শক্তির অধিকারী, যিনি এ পৃথিবী থেকে শত শত কোটি গুণ বড় বড় অসংখ্য-অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করে মহাশূন্যে স্থাপন করে রেখেছেন। যার কুদরতে সেগুলো মহাশূন্যে ভাসছে। সে মহান সত্তা কত মহা শক্তির অধিকারী! তাই তিনি যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি তাঁর বাণীও ততটা শ্রেষ্ঠ হবে। এ সম্পর্ক রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘সমস্ত বাণীর ওপর আল্লাহ তায়ালার বাণীর মর্যাদা, সৃষ্টি জগতের ওপর আল্লাহ তায়ালার মর্যাদার মতো।’ (সুনানে দারেমি : ৩৩৫৭)। অতএব আল্লাহ তায়ালার এ আজমত (বড়ত্বের) অনুভূতি অন্তরে নিয়ে যখন কোরআন পাঠ করা হবে, তখনই কোরআনুল করিম দ্বারা হেদায়েত লাভ হবে।

চতুর্থ, অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা থাকা

আল্লাহ তায়ালার প্রতি মহব্বত-ভালোবাসা থাকতে হবে। যাদের অন্তরে আল্লাহার প্রতি মহব্বত-ভালোবাসা রয়েছে, কোরআনুল কারিম দ্বারা তারাই উপকৃত হবে। কারণ যার অন্তরে যার প্রতি যত বেশি মহব্বত-ভালোবাসা থাকে, তার কথা তার অন্তরে তত বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে এরশাদ করেন, ‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন তাদের অন্তÍর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে কালাম পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের প্রতিপালকের প্রতি ভরসা করে।’ (সূরা আনফাল : ২)। যেমন প্রবাসী বাবা যদি তার সন্তানের কাছে চিঠি প্রেরণ করেন, আর সন্তানের অন্তরে তার বাবার প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে সে তার বাবার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত চিঠি পাঠ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাবে না।

পঞ্চম, চেষ্টা-মোজাহাদা করা

কোরআনুল কারিম মানব রচিত কোনো গ্রন্থ নয় যে, কেউ যদি আরবি ভাষা জানে, আর সে কোরআনুল কারিম পাঠ করলেই তার অর্থ ও মর্ম বুঝে ফেলবে। কোরআন থেকে যে ফায়দা হাসিল হওয়ার তা হাসিল হয়ে যাবে। কেননা যদিও আল্লাহ কোরআনে তাঁর অসীম ক্ষমতার বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক তথ্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য বর্ণনা নয়; বরং তা বিশ্বমানবতার হেদায়েত, আর এ হেদায়েত লাভ করতে হলে চেষ্টা-মুজাহাদা করা, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা আবশ্যক। কেননা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউ নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা কোরআন থেকে হেদায়েত লাভ করতে পারে না।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, ১৯ অক্টোবর   ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস