ডিজিটাল লেনদেনে নতুন মাত্রা

মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত করে তুলেছে কভিড পরিস্থিতি। ফলে বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণের ভীতি গত কয়েক মাস অনেকটা কেটে গেলেও আর্থিক লেনদেনে অনলাইননির্ভরতা কমেনি, বরং বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোরও রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। কারণ করোনার সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকের জন্য চালু করেছে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা। বিশেষ করে ঘরে বসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, অনলাইনে টাকা ট্রান্সফার এবং অনলাইনে কেনাকাটাসহ নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে ব্যাংকগুলোতে। কয়েকটি ব্যাংক ঘরে বসে চলতি মূলধন ঋণের আবেদনের জন্য নতুন অ্যাপসও চালু করেছে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত হওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল লেনদেনেও পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত গতি। এ সময়ে ব্যাংকের ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রি-পেইড কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ও লেনদেন দুই-ই বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সশরীরে ব্যাংকে গিয়ে লেনদেনে সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয় রয়েছে। এসব কারণে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই ডিজিটাল লেনদেনে মানুষকে উৎসাহিত করে আসছে ব্যাংকগুলো। বেশির ভাগ ব্যাংকই গ্রাহকদের মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তথা স্মার্ট অ্যাপ, এটিএম এবং ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করার পরামর্শ দিয়েছে। এ সময়ে কার্ডভিত্তিক লেনদেনের সীমাও বাড়ানো হয়েছে। যেকোনো এটিএম বুথ থেকে ফি ছাড়াই টাকা তোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং গ্রাহকরাও ডিজিটাল লেনদেনে আগ্রহী হচ্ছে।

বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভারের পর থেকেই গ্রাহকদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি। এ সময় গ্রাহকদের সশরীরে শাখায় না এসে তার পরিবর্তে এটিএম, সিআরএম, সিডিএমে লেনদেনের পরামর্শ দিই। এটিএম থেকে টাকা তোলার সীমাও বাড়ানো হয়েছে। ফলে ডিজিটাল লেনদেনে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।’

জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার ঘটছে অনেক আগেই। ব্যাংকিং সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ভিসা কার্ড এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও জমা, রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ ও বেতন-ভাতা প্রদান সবই সম্ভব হচ্ছে। করোনার সময়ে এসব প্রযুক্তির ব্যবহারে গ্রাহকদের আরো উৎসাহিত করেছে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী বলেন, ‘কভিড-১৯-এর অনেক খারাপ দিকের মধ্যে একটা ভালো দিক হলো—এটা বাংলাদেশের ডিজিটাইজেশনকে দুই থেকে চার বছর এগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের কমিউনিকেশন, জিজিটাল স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ ও কাস্টমারদের উৎসাহের সঙ্গে এই সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে করোনার সময়ে আমরাও গ্রাহকদের নতুন নতুন সেবার অফার করেছি, যাতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ে। ফলে করোনা ভীতি কাটার পরও ডিজিটাল লেনদেনে আগ্রহী হচ্ছে মানুষ।’

করোনার সময় ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকদের উৎসাহিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে করোনার কারণে ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে কার্ডভিত্তিক লেনদেনে কোনো ধরনের চার্জ না কাটার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনার কারণে ওষুধ ও নিত্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সীমা বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকের ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ছিল এক কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪৩ জন। সেটি বেড়ে গত নভেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৬ জনে। এর মানে করোনার গত ৯ মাসে ডেবিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭৩ জন। আর নভেম্বর মাসে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ১৭ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এদিকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৮০৬ জন, যা গত নভেম্বর মাসে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫১৮ জন।

ফলে করোনার গত ৯ মাসে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৬৬ হাজার ৭১২ জন। নভেম্বর মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে প্রি-পেইড কার্ডের গ্রাহক ছিল চার লাখ ৭৯ হাজার ৩৮১ জন। গত নভেম্বর মাসে তা বেড়ে হয়েছে ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৭১৮ জন। ফলে করোনায় ৯ মাসে প্রি-পেইড কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে দুই লাখ আট হাজার ৩৩৭ জন। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকসংখ্যা ছিল ২৬ লাখ পাঁচ হাজার ১৭৬ জন। গত নভেম্বর শেষে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক বেড়ে হয়েছে ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪৮ জন। ফলে করোনার ৯ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক বেড়েছে পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার ৭৭২ জন। নভেম্বর মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে আট হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক ও লেনদেন দুই-ই বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ছিল আট কোটি ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৯৬ জন, যা গত নভেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ৯ কোটি ৭৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৫৫ জন। এই হিসাবে করোনায় গত ৯ মাসে এই সেবায় গ্রাহক বেড়েছে প্রায় এক কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার ৭৫৯ জন। এ ছাড়া নভেম্বর মাসে এই সেবার আওতায় মোট লেনদেন হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৫৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। করোনার শুরুর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৪১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।