modi3

মোদির সামনে নতুন যে পরীক্ষা

এক দশক ধরে ভারতের শাসন ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। পুরো এ সময়ে তিনি ও তার দল বলে এসেছেন, তারা এক ‘নতুন ভারত’-এর প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাদের বক্তব্য, এ ‘নতুন ভারত’-এ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কোনো জায়গা নেই। যে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বিরোধী দলগুলোতে রয়েছে বলে দাবি তাদের।

এরপর বুধবার (৫ জুন) সকালে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশটি ভিন্ন এক ‘নতুন ভারত’ দেখল। বিজেপি তার গত এক দশক ধরে বজায় রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। এবারের নির্বাচন একদিকে যেমন দলটিকে একটা ধাক্কা দিয়েছে, অন্যদিকে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে দলটির মধ্যে কিছুটা হলেও একটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

এর আগে পরপর দুবার সরকার গঠন করতে জোটসঙ্গীদের ওপর ভরসা করতে হয়নি মোদিকে। কাউকে সন্তুষ্ট করারও দরকার পড়েনি। সেই মোদিকেই এবার ম্যাজিক ফিগার (লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে সরকার গড়তে ২৭২টি আসন প্রয়োজন) পার করতে না পারায় জোটের সঙ্গীদের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।

শনিবার (১ জুন) শেষ দফার ভোটের পর বেশিরভাগ বুথফেরত জরিপে বিজেপি ও এনডিএর ভূমিধস জয়ের যে পূর্বাভাস দেয়া হয়, মঙ্গলবার (৪ মে) সেই পূর্বাভাসকে উড়িয়ে দিয়ে ইন্ডিয়া জোট লোকসভায় ২৩২টি আসন জিততে সক্ষম হয়। অন্যদিকে বিজেপি অবশ্য ২৪০টি আসন নিয়ে ভারতের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় সংখ্যাটি অনেক কম।

ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরই বুধবার (৫ মে) বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট উভয়ের নেতারা নয়াদিল্লিতে ছোটেন। উদ্দেশ্য পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে পরিকল্পনা সাজানো।

এদিন দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ও বিহার রাজ্যের জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডিইউসহ মিত্র দলগুলো জোট সরকার গড়ার ব্যাপারে মোদি ও বিজেপিকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

সেই সঙ্গে মোদিকে ‘সর্বসম্মতিক্রমে এনডিএ-র নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে। এনডিএ জোট সামগ্রিকভাবে ২৯৩টি আসন জেতায় সরকার গঠন এখন অনেকটাই নিশ্চিত।

এদিকে, কয়েক ঘণ্টা পরই ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘বিরোধী জোট মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে।’

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সরকার গঠন নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্লেষক ও রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোট সরকার গঠিত হলে অন্য দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল প্রধানমন্ত্রী মোদি কি সরকারকে শাসন করতে পারবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন। যেমন নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ (সিপিআর)-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার বলছেন, ‘এটা এখনও অজানা। মোদি এমন একজন নেতা হিসেবে পরিচিত, যিনি শুধুমাত্র চরম কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত।’

মোদির সামনে নতুন পরীক্ষা
নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশের মধ্যে মঙ্গলবার (৪ মে) সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে কথা বলেন মোদি। এ সময় তিনি আগেভাগেই বিহারে ক্ষমতাসীন জোটের জন্য বড় জয় এনে দেয়ায় জেডি(ইউ) নেতা নীতিশ কুমারকে কৃতিত্ব দেন। জেডি(ইউ) ১২টি আসনে জয় পেয়েছে।

অতীতে এই দুই রাজনীতিকের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে অম্ল-মধুর সম্পর্ক দেখা গেছে। তাদের সম্পর্ক এই ভাঙে তো এই জোড়া লাগে। বহুবার এমনটা ঘটেছে। জেডি(ইউ)-এর মতো তেলেগু দেশম পার্টি তথা টিডিপিও বিভিন্ন সময় বিজেপি ও বিরোধী কংগ্রেস উভয়ের সাথেই জোট করেছে।

তবে বিজেপি যেখানে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত, সেখানে জেডি(ইউ) ও টিডিপি উভয়ই নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে, মুসলিম ভোটারদের সমর্থনের উপর নির্ভর করে এবং বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। টিডিপি এবার ১৬টি আসন জিতেছে।

দুই দল মিলে মোট আসন দাঁড়ায় ২৮। এ জন্য তাদেরকে বাগিয়ে নিজেদের জোটে ভেড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইন্ডিয়া জোট। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় খবর অনুসারে, এ জন্য জোটের অন্যতম নেতা ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) বর্ষীয়ান নেতা শারদ পাওয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

যদি ইন্ডিয়া জোট এ দুটি দলকে তাদের দিকে ভেড়াতে পারে তাহলে মোদির এনডিএ জোটের মোট আসন ২৯৩ থেকে কমে দাঁড়াবে ২৬৫। তখন এনডিএ সরকার গঠন করতে পারবে না। তখন ইন্ডিয়া জোটের আসন দাঁড়াবে ২৬৮টি। ফলে তাদের ২৭২ পূরণ করতে বাকি থাকবে ৪টি আসন। তারা অন্য ছোট দলগুলোর কাছ থেকে সেই ৪টি আসন নিয়ে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখতেই পারে।

ভারতে নির্বাচনের পর চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতিশ কুমারকে নিয়ে তাই এত আলোচনা। এ জন্য তাদের দু’জনকে বলা হচ্ছে কিংমেকার। তারা যেদিকে ঝুঁকবেন, সরকার গঠনের সুযোগ তাদের সামনে উন্মুক্ত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজেপি দাবি করেছে, এই দুই নেতা তাদেরকে লিখিত দিয়েছেন যে, তারা এনডিএ’র সঙ্গেই থাকবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি সফলভাবে মোদিকে একজন শক্তিশালী, নির্ণায়ক নেতা হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে, যিনি রাজনীতিকে মূল নীতির পথে বাধা হয়ে আসতে দেন না। সেটা সম্ভব হয়েছে। কারণ মোদিকে কখনোই স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া শাসন করতে হয়নি।

মোদি ২০০১ সালে গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় প্রথম জাতীয় খ্যাতি অর্জন করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৩ বছর রাজ্য শাসন করেন তিনি। গুজরাটে এবং পরবর্তীতে জাতীয় পরিসরে মোদির বরাবরই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং এখন পর্যন্ত রয়েছে।

তবে এবার লোকসভা নির্বাচনে ‘ব্র্যান্ড মোদি’ একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। যেমনটা বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদ কিদওয়াই। তার মতে, নির্বাচনের ফলাফল ‘জোটের রাজনীতিকে মোদির জন্য বাধ্যতামূলক’ করে তুলেছে। এর মধ্যদিয়ে ভারতকে তিনি সেই ২০১৪-এর আগের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন যে সময় জোট সরকার ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।

কিদওয়াই বলেন, ‘এটা মোদির জন্য কঠিন হবে। কারণ মিত্রদের সবসময় গুরুত্বপূর্ণ পদসহ কিছু প্রত্যাশাও থাকবে। ফলে এখন জোট সরকারের অধীনে মোদির দর কষাকষির দক্ষতা নতুন পরীক্ষায় পড়বে। তিনি আরও বলেন, সেসব প্রত্যাশার মধ্যে সংসদে স্পিকার পদের জন্য মিত্রদের দাবিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

পার্লামেন্টে যদিও স্পিকারের বেশিরভাগই একটি আনুষ্ঠানিক ভূমিকা থাকে, তবে সংসদ সদস্যরা যদি দল ভাঙতে চান, তখন পদটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্পিকার এই ধরনের প্রচেষ্টার বৈধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অতীতে বিজেপির বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির মতো বিরোধীদের বিভক্ত করার অভিযোগ উঠেছে।

মিত্ররা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদও চাইবে। সেক্ষেত্রে ‘খেলাটা হবে মিত্রদের খুশি রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রীপদ ছেড়ে দেয়া। তবে আমরা যেমনটা দেখেছি মন্ত্রীরা এই সরকারে খুব বেশি কিছু না, বলছিলেন সিপিআরের নীলাঞ্জন সরকার। তথাপি মোদি যদি ক্ষমতাসীন জোট কার্যকর রাখতে চান তবে তাকে শরিকদের এসব দাবিগুলো মেটাতে হবে, বলছেন মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘মোদির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি যদি গত ১০ বছর ধরে যেমন আচরণ করেছেন, সেভাবে আচরণ করতে চান, তাহলে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তিনি আরও বলেন, মোদিকে তাই নিজের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব নিয়ে আসতে হবে যা নম্র এবং অন্যদের সাথে কাজ করার ব্যাপারে উন্মুক্ত। এটা এমন একটা দিক যা আমরা কখনও দেখিনি।

Scroll to Top