যে কারণে রোহিঙ্গাদের পাশে নেই সু চি

মিয়ানমারের ক্ষমতার রাশ এমন একজনের হাতে, যিনি গণতন্ত্রের নেত্রী, মানবাধিকার আদায়ে সুবিদিত মুখ, শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি। দীর্ঘদিন গৃহবন্দীসহ জান্তা সরকারের দমননীতি তিনি কম সহ্য করেননি। দুই দশকের বেশি তিনি দেশটির সামরিক সরকারের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। তবু দেশ ছেড়ে চলে যাননি। গত বছর তাঁর দল ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট পদে না থাকলেও স্টেট কাউন্সিলরসহ সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থাকা সু চি দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সংকটে কিছু করছেন না কেন—এই প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে।

প্রথমত, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির বর্তমান এই নীরবতা খুব নতুন কিছু নয়। কারণ এই ইস্যুতে তিনি বরাবর নীরবই থেকেছেন। মিয়ানমারের নেত্রী সু চি কখনো রোহিঙ্গাদের প্রতি খুব বেশি সহানুভূতি দেখাননি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রচারাভিযানের সময় সু চি রাখাইনের সহিংসতার ইস্যুটি এড়িয়ে গেছেন।

এমনও হতে পারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরবতা বা সু চির অনাগ্রহ একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু একেবারে নিশ্চিতভাবে তা বলাও যায় না। সু চির জীবনীগ্রন্থের লেখক পিটার পোফাম লিখেছেন, সু চি গোঁড়া নন। তাঁর মুসলমান জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রয়েছে (যদিও রোহিঙ্গা নয়)।

অং সান সু চি তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রতিনিধিত্ব করছেন এটা বললেও ভুল হবে না। কারণ এনএলডির একটা বড় অংশই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তাঁরা রোহিঙ্গাদের বহিরাগত মনে করেন। দেশটির অধিকাংশ লোকই রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে থাকেন। এমনও বলেন যে তাঁদের ওই দেশে বাস করার অধিকার নেই। যদিও রোহিঙ্গারা দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে সেখানেই রয়েছেন। এমনকি অং সান সু চি গত বছর মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন রাখাইনের মুসলিম সংখ্যালঘুদের রোহিঙ্গা নামে অভিহিত না করতে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর মনোভাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুযোগ যে নেই, তা সু চি ভালোভাবে বোঝেন। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে সু চি তাঁর দলের পক্ষ থেকে কোনো মুসলিম প্রার্থী দেননি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীপ্রধান দেশটির অন্যান্য গণতন্ত্রপন্থী নেতা যাঁরা কিনা জান্তা সরকারের আমলে নানা দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁদের মনোভাব সু চির চেয়ে আরও বেশি বিরূপ।

অং সান সু চি ক্ষমতায় বসার পর অন্তত মন্ত্রণালয়গুলো সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে না। আর তিনি ইতিমধ্যে সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রাধান্যের বিষয়গুলো কী। একটি হলো মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, অপরটি হলো দেশটির উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র নৃগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিবাদ মেটানো।

সু চি এমনও ভাবতে পারেন, রাখাইনে চলা সামরিক অভিযান বন্ধে তাঁর ক্ষমতা সীমিত। দেশটির ক্ষমতার রাশ সু চির হাতে থাকলেও সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াংয়ের হাতেও রয়েছে যথেষ্ট ক্ষমতা। নিরাপত্তা ইস্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সামরিক বাজেটের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আগে থেকেই নিশ্চিত করা আছে সামরিক আমলে করা মিয়ানমারের সংবিধানে। আর পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাসদস্যদের জন্য বরাদ্দ থাকার তথ্যও কারও অজানা নয়।

এত কিছু সত্ত্বেও সু চি চাইলেই পারেন অনেক কিছু করতে। পারেন রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ তৎপরতায় আন্তর্জাতিক মহলের নজর টানতে। কিংবা মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়া সংখ্যালঘুদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে। কারণ সবশেষে তিনি হলেন মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা, যিনি ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন, তাই সু চি রাখাইন পরিদর্শনে গেলে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী দল এবং সেনাবাহিনীর জেনারেলরা তাঁর ওপর মনঃক্ষুণ্ন হলেও কার্যত থামাতে পারবেন, এমনটা মনে করার কারণ নেই। সু চি তা বোঝেনও। তবু রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটে দৃশ্যত নীরব ভূমিকায় রয়ে যাচ্ছেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম