প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতদের রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর গুরুত্বারোপের আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শনিবার লন্ডনে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে যোগ দিয়ে এ আহবান জানান। সম্মেলনের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলেন, দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মসূচি যাতে অব্যাহত থাকে, সেজন্য রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত ১৫ জন রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং স্থায়ী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেন। এর শিরোনাম হচ্ছে- ‘দূত (ইউরোপ) সম্মেলন’। শনিবার বিকেলে (লন্ডন সময়) স্থানীয় একটি হোটেলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি দূতদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী ও দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন, অভিবাসন ও রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ও সম্মেলনে আলোচনা হয়।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা কূটনীতিকদের একটি সময়োপযোগী এবং কার্যকর অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণের পরামর্শ দেন, যাতে করে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর ও নিবিড় হয়। তিনি বলেন, এই জন্য দেশে বিনিয়োগের আরো সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের এখন একটি বৃহৎ এবং দক্ষ যুবশক্তি রয়েছে, যারা বিশ্ব শ্রম বাজারের চাহিদা পূরণে সক্ষম। একটি দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে এমন একটি অ্যাপ চালু করেছি যার মাধ্যমে জনগণ ৯টি ভাষা শিখতে পারছে। প্রধানমন্ত্রী দূতগণকে নিজ নিজ কর্মস্থলে বিভিন্ন দেশের বাজার পরিবীক্ষণ করে সে দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বাধাগুলো চিহ্নিত করার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী প্রবাসে কর্মরত কূটনীতিকদের এ লক্ষ্য অনুসরণে তাদেরও নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রয়োজনে দ্র“ত এবং উন্নত সেবা প্রদানের জন্যও কূটনীতিকদের প্রতি আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ৮ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি এবং চলতি ২০১৯-’২০ অর্থবছরের শেষ নাগাদ যা ৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করা আমাদের লক্ষ্য। একইসঙ্গে ২০২০ সাল নাগাদ আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ এখন আর সাহায্য নির্ভর নয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এবারে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করেছি এবং এর ৯০ শতাংশ অর্থ আমাদের নিজস্ব উৎস থেকে যোগান দেওয়া হবে। দেশের কিছু লোক এবং যারা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে তারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা দেশের উন্নয়নের গতি থামিয়ে দিতে চাচ্ছে। তিনি বিএনপির নাম উল্লেখ করে বলেন, তারা বিগত নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অথচ, তারা এই নির্বাচনে যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস করে না, বরং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আস্থা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জনকে গুরুত্ব দেয়।
সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুসৃত এই পররাষ্ট্র নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এই পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি বলেন, এই নীতি অনুসরণ করে তার সরকার কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়সহ অনেক বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। আমরা আশা করি, একইভাবে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুরও সমাধান হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দেশ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে।
সম্মেলনে যোগদানকারী দূতরা হলেন, আবু জাফর (অস্ট্রিয়া), মো. শাহাদৎ হোসেন (বেলজিয়াম), মুহম্মদ আবদুল মুহিত (ডেনমার্ক), কাজী ইমতিয়াজ হোসেন (ফ্রান্স), ইমতিয়াজ আহমেদ (জার্মানি), জসিম উদ্দিন (গ্রিস), আবদুস সোবহান সিকদার (ইতালি), শেখ মোহাম্মদ বেলাল (নেদারল্যান্ডস), মাহফুজুর রহমান (পোল্যান্ড), রুহুল আলম সিদ্দিক (পর্তুগাল), ড. এস এম সাইফুল হক (রাশিয়া), হাসান মাহমুদ খন্দকার (স্পেন), নাজমুল ইসলাম (সুইডেন), শামীম আহসান (সুইজারল্যান্ড) এবং সাইদা মুনা তাসনীম (যুক্তরাজ্য)। সম্মেলনে দূতরা সংশিষ্ট দেশে তাদের নিজ নিজ কার্যক্রম, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা পৃথকভাবে উপস্থাপন করেন। যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলন এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নিতে এক সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার বিকেলে লন্ডন পৌঁছেন। আগামী ৫ আগস্ট তিনি দেশে ফিরবেন।