ঢাকা অ্যাটাক-সিন্ডিকেটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো এক জয়!

তানভীর খালেদ
দেশের সিনেমার সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানেন? এখানে অসংখ্য বিভাজন। এফডিসির সিন্ডিকেট নকলবাজের রাজত্ব যৌথ প্রযোজনা দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি জিম্মি করাদের দৌরত্ন্য! এদের কারণে বরাবরই দেশের সবচেয়ে মেধাবী নাটক ও বিজ্ঞাপন কলাকুশলীদের আমরা সিনেমায় পায়নি। বারবার উনাদের সিনেমার সাথে হয়েছে নোংরা রাজনীতি! রাজনীতির কবলে নিজেদের ভাল কাজও সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ হয়নি। বরাবরই ভয় ছিল নাটক নির্মাতা মানেই তার ছবি টিভিতে প্রিমিয়ার হবে অথবা হাতেগোনা কয়েকটি হল পাবে। তাই বাজেটের অভাবে নিজেদের স্বপ্নকে করে ফেলতে হতো সংকুচিত! মেধাবী পরিচালকদের কাজগুলো ভাল বাজেটের অভাবে তকমা পেত নাটক কিংবা টেলিফিল্মের!

প্রথমেই ধন্যবাদ পুলিশ পরিবারকে যারা সাহস দেখিয়েছেন সিনেমা নামক স্বপ্নের ঘুড়িকে ইচ্ছেমত ওড়ানোর। তারপর ঢাকা অ্যাটাকের পরিবেশকদের যারা সাহস করে কোন সুপারস্টার কিংবা যৌথ প্রতারণার সিনেমা না হওয়া সত্যেও এতগুলো হলে মুক্তি দিয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ঢাকা অ্যাটাক প্রেক্ষাগৃহে যথেষ্ট উপভোগ করলাম। এরকম বলব না এটি একেবারে হলিউড-বলিউড মানের হয়ে গেছে। তবে আমাদের দেশী আবহে যতটুকু দেখা গিয়েছে তাতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলাই যায়। সবচেয়ে বড় দেশের ইন্ডাস্ট্রির জন্য সিনেমাটি অনেক বেশি ইতিবাচক ছিল। রিভিউ লেখছিনা। তবে গত অনেকদিন ধরে দেশের সিনেমার যে নোংরামিগুলো মিডিয়াতে দেখেছি সেই দৃষ্টিকোন থেকে ঢাকা অ্যাটাকের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরলাম।

*একক প্রযোজনার হিট সিনেমা:
যৌথ প্রযোজনার বিষ আমাদের চলচ্চিত্রে খুবই ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মধ্যে ধারণা হয়ে গেছে যৌথ প্রযোজনা ছাড়া এদেশে ভাল কিংবা হিট সিনেমা সম্ভব না। সত্যি বলতে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা যদি হিট ও হয় আমাদের ইন্ডাস্ট্রির তেমন কোন লাভ নেই। পুরো কৃতিত্বই কলকাতার নির্মাণশৈলীর প্রযুক্তির কিংবা ডিরেক্টরদের্। গতবছর এই সময়ে আয়নাবাজির সাথে যৌথ প্রযোজনার নামে কলকাতার সিনেমা পায় ১০০ হল যেখানে আয়নাবাজি পেয়েছিল ২৪ টা! একবার ভাবুন আজ যদি দেশে যৌথ প্রযোজনা নিষিদ্ধ না হত তাহলে ‘ককপিট’ বা ‘ইয়েতি অভিযানে’র কারণে ঢাকা অ্যাটাক কয়টা হল পেত? এফডিসিতে সিন্ডিকেট করে যারা বছরের পর বছর চলচ্চিত্র শিল্পটাকে জঘন্যতম অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে সেই সকল আলু পটল ব্যাবসায়ীদেরও সাহস ছিল না যৌথ প্রতারণাকে ফিল্ম বানিয়ে টক্কর দেয়ার্। কিন্তু আমাদের ছোটপর্দা থেকে আসা এক ডিরেক্টর এফডিসির সেই সিন্ডিকেটবাজদের কারও সাহায্য ছাড়াই প্রথম সিনেমাতে সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলেন।

*দৃশ্যায়ন:
সত্যি বলতে এ সিনেমার দৃশ্যায়ন যে কোন বাংলা সিনেমার দৃশ্যায়ন থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। একেবারে বাস্তবসম্মত পুলিশী অভিযানের নিখুঁত চিত্র, একেবারে গেইমের স্টাইলে সোয়াট অভিযান, পাহাড়ি অভিযান, বোম ডিজপোজালের বিষয়গুলো ছিল দুর্দান্ত!

*শুভ:
বাংলাদেশে রিউমার আছে যাকে মানুষ টিভিতে ফ্রী দেখতে পায় তাকে টাকা দিয়ে হলে দেখতে আসবে কেন। এখানে মেধা বা পরিশ্রমের মূল্য খুব একটা নেই। নাটক ছেড়ে এসে সিনেমায় ক্যরিয়ারের শুরু থেকেই শুভ প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। বিদেশে গিয়ে ড্যান্স শিখে এসেছেন। টাকার পিছনে দৌড়ে হাজার হাজার ছবিতে সাইন করেননি। অগ্নি, ঢাকা অ্যাটাকের শুটিং করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। ভারত প্রাধান্য পায়, এমন যৌথ প্রযোজনায় অভিনয়ও করেন নি। এরকম ডেডিকেশনের পরেও কোন ক্লিন হিট ছিল না। অগ্নি হিট হলেও পুরো কৃতিত্ব পেয়েছে মাহি কিংবা জাজ। মুসাফির, ছুঁয়ে দিলে মন- যথেষ্ট ভাল সিনেমা কিন্ত ক্লিন হিট না। যদিও শুভর অভিনয় ঢাকা অ্যাটাকে আহামরি রকমের ভালো হয় নি, কিন্তু শেষমেষ ক্লিন হিট একটা সিনেমা পেলেন তিনি- বিষয়টা দেশের সিনেমার জন্য অনেক বড় ইতিবাচক! বেছে বেছে অভিনয় করার পুরষ্কার পেলেন তিনি।

*সুমন
কথায় আছে আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী! সবসময় মনে করি সিনেমায় সুদর্শন নায়কদের সংখ্যা যত বাড়বে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ তত বাড়বে। এবিএম সুমনের মত বডি বিল্ডারদের সিনেমায় দরকার! এ সিনেমায় প্রত্যাশার চেয়েও ভাল পারফর্ম করেছেন সুমন। একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছেন বলব। এখন হাই টাইম ‘আদি’ মুক্তি দেয়ার্। পর পর দুইটা ভাল সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা আরেকজন স্টার পাবে।

*পুলিশ
বাংলাদেশে সরাসরি কোন বড় সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা সিনেমায় তেমন দেখা যায় না। পুলিশের সংশ্লিষ্টতার কারণেই আমরা বাস্তবিকভাবে পুলিশী অভিযান গুলো দেখতে পেয়েছি যা ছিল সিনেমার প্রাণ! এ সিনেমাটি সফল না হলে আর কোন সংগঠন এভাবে চলচ্চিত্রটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করত না হয়তো!

*আইটেম
বিপাশার আইটেম গান সিনেমায় বিষফোঁড়ার মত হয়ে গিয়েছিল। অথচ আইটেম গান মানেই অশ্লীল নৃত্য না। যদিও ব্যক্তিগতভাবে মিমো অপছন্দের, কিন্তু রুচিশীলভাবে চিত্রায়িত আইটেম গানটি বেশ ভাল লেগেছে।

*সাধারণ দর্শকদের মন জয়
আমাদের দেশের সিনেমার প্রধান দর্শক নিম্নবিত্ত মানুষ! নাটক থেকে আসা পরিচালকবৃন্দের সিনেমার একটি সমস্যা ছিল সেই নিম্নবিত্ত মানুষ তাদের সিনেমা গুলোকে গ্রহন করছিল না। ঢাকা অ্যাটাক এই মানুষগুলোর সাথে উপভোগ করে যা বুঝলাম এতে ওদের উপভোগ করার মত যথেষ্ট উপাদান ছিল।

*শতাব্দী ওয়াদুদ
শতাব্দীর মত প্রতিথযশা মঞ্চ অভিনেতাদের অভিনয় নাটক পর্যন্তই ছিল। সিনেমায় তারা না আসলে সেটা দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্যই অপূর্ণতা। পরিচালক প্রযোজকদের ধন্যবাদ এফডিসির তথাকথিত কোন অভিনেতাদের না নিয়ে প্রতিথযশা অভিনেতাদের অভিনয় দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।

*মাহি  
সিনেমায় আমার কাছে সবচেয়ে বাজে এলিমেন্ট ছিল মাহি। বরাবরই বিরক্তিকর ছিল। প্রথমত, অপ্রয়োজনীয়ভাবে চরিত্রটিকে অতিরিক্ত ফুটেজ দেয়া! দ্বিতীয়ত- এতগুলো সিনেমা করেও এত কাঁচা অভিনয়! তবুও দিনশেষে জাজের বাইরে মাহির একটা হিট সিনেমা দরকার ছিল।

পরিশেষে : মনপুরা, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, ছুঁয়ে দিলে মন, আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক! দেশের নাটক নির্মাতাদের সিনেমা নাকি হলে চলে না! এরপর আসছে ডুব-হালদা-স্বপ্নজাল! আহা! দেশের সবচেয়ে মেধাবী নির্মাতারা আসছেন সিনেমায়। সিন্ডিকেটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রেক্ষাগৃহে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের সিনেমার জন্য এর চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে? দেশের সিনেমায় এদের হাত ধরেই আলোর দেখা মিলবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, ০৮ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম