নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এবং রাজনৈতিক দল

শারমিন শামস্
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্বাচনমুখী হচ্ছে। এরমধ্যে বিএনপি ও এর কয়েকটি মিত্র দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে। এদের প্রায় সকলেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে।

প্রসঙ্গত, ইসি তার রোডম্যাপে সংলাপের জন্য যে সুনির্দিষ্ট সাতটি বিষয় নির্ধারণ করেছে, সেগুলো হলো—আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন-প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগীকরণ, সংসদীয় সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম।

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সঙ্গে ইসির সংলাপের পর এখন যে বিষয়টা আলোচনার কেন্দ্রে তা হলো, সিইসি’র মুখে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়া ও খালেদা জিয়ার ভূয়সী প্রশংসা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তক বলে মন্তব্য করেছেন। বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমি বিএনপির শাসন আমলেও চাকরি করেছি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ভালো ভালো কাজ করেছে। সিইসি আরও বলেছেন, বিএনপির এই সংলাপের দিকে জাতি তাকিয়ে আছে। দলটি অনেক বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। তাদের দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে।’

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এই সংলাপের পর বিএনপি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি’র জন্য যে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এই আশাবাদী হওয়ার ব্যাপারটা তাতে এক পশলা দখিনা হাওয়ার মতো অবশ্যই। যদিও সিইসি’র বক্তব্যের সমালোচনা চলছে। কোন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোন দলের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন সম্পর্কে এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে পারেন কিনা, তাই নিয়ে চলছে তর্ক বিতর্ক। এরই মধ্যে জিয়াকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলায় ইসির পদত্যাগ দাবি করেছেন কাদের সিদ্দিকী। কিন্তু এসবের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য কিন্তু অন্য সুর ধরেছে। তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের প্রশংসার বিষয়টি বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কৌশল হতে পারে। বিএনপি এখন খুশি খুশি। এই ভাবটা যেন নির্বাচন পর্যন্ত বজায় থাকে।’

ওবায়দুল কাদের কথা খারাপ বলেননি। যথেষ্ট যৌক্তিক কথা। ২০১১ সালের পর গত ৬ বছরে বিএনপি বিগত দুই কমিশনে সংলাপের আমন্ত্রণ পেলেও অংশ নেয়নি। ২০১১ সালের জুনে তৎকালীন সিইসি এটিএম শামসুল হুদা কমিশন বিএনপি’কে সংলাপের বিষয়ে তিনবার চিঠি দেয়। এর মধ্যে সংলাপে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে দু’বার চিঠি দিলেও বিএনপি সাড়া দেয়নি। ওই বছরের জুনে কমিশনকে চিঠি দিয়ে দলটি তাদের অনাস্থার কথা জানিয়ে সংলাপ প্রত্যাখ্যান করে। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ কমিশনের সংলাপে যায়নি বিএনপি। এই কমিশনের সংলাপকে ‘অকার্যকর’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে চিঠি দিয়েছিলো দলটি।

এছাড়া, ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর ইসি গঠন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত প্রস্তাব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর কয়েক দফায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় বঙ্গভবনে। পরে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বিএনপিসহ পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে ইসি গঠন ইস্যুতে আলোচনার জন্য বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংলাপ শুরু হয়। সংলাপে রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে লিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বর্তমান ইসি’র গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার কারণেই হুদা কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়ার বিষয়ে শুরু থেকে ইতিবাচক ছিল বিএনপি। গত ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সংলাপে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয় এবং প্রত্যেক সিনিয়র নেতাই আলোচনা করেন।

গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার কারণে ইসি’র সংলাপ এড়িয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে চায়নি বিএনপি। আবার সংলাপে গিয়ে সিইসি’র কথায় বিএনপি এখন বেশ সন্তুষ্ট। কিন্তু এখনও আস্থাশীল নয়, এও তারা জানিয়েছে। তবে গত কয়েক বছরের রাজনীতির অঙ্গনে বিএনপি’র কোণঠাসা অবস্থা ও তাদের একগুঁয়েমী, আওয়ামী লীগের একচেটিয়া অবস্থান, বিরোধী দল বলে প্রকৃত অর্থে কিছুই না থাকার মতো পরিস্থিতিতে ইসির সঙ্গে এই সংলাপ, বিএনপি’র সঙ্গে আন্তরিক কথপোকথন আমাদের আশাবাদী করে তোলে। আমরা ভাবতে শুরু করতে পারি যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দিকে ইসি যাত্রা শুরু করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, এর আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রক্তাক্ত হানাহানির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশকে যেতে হয়েছে, সেই রক্তপাতের ইতিহাস যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটা এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া। এক্ষেত্রে বিএনপিকে সংলাপে আনা, আলোচনা চালানোর মধ্যদিয়ে ক্রমে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণকে সাবলীল করে তোলাটা ইসির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ হিসেবে ইসি যদি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করেন, সেটা ইতিবাচক। মোদ্দা কথা, দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা চলমান রাখা, হিংসা ও হানাহানির পথ রুদ্ধ করতে দায়িত্বশীল জায়গাগুলোকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার এবং সার্বিক অর্থে আওয়ামী লীগেরও ইসির কাছ থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে।

পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির অভ্যাস বাদ দিয়ে একটি সভ্য সুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে না তুলতে পারলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কখনোই স্থিতিশীল হবে না। এক্ষেত্রে বিএনপিকেও সেই মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। আবার বিএনপি যদি মুখে ভালো কথা, কিন্তু তলে তলে দেশে নানারকম অরাজক পরিস্থিতি তৈরির ষড়যন্ত্র করার পুরাতন অভ্যাসটি ধরে রাখে, তবে সেটি তাদের জন্য বুমেরাং হিসেবেই ফেরত আসবে। রাজনীতি চর্চার মাঠে কোণঠাসা বিএনপিকে পা ফেলতে হবে তাই বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করেই। তাদের মনে রাখতে হবে, একের পর এক হত্যা, রক্তপাত, হানাহানির ষড়যন্ত্র করে তারা শেষপর্যন্ত কিছুই অর্জন করতে পারেনি।

এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসি এবং সরকারের দূরদর্শী আচরণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। গতবার নির্বাচনে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল সেই একই বিতর্কের ভেতর দিয়ে আবারও যাওয়ার ইচ্ছে বা পরিকল্পনা সরকারের নেই বলেই আশা করা যায়। নির্বাচনমুখী আবহাওয়ায় বিএনপি সেই সুযোগটাই গ্রহণ করতে পারে। আর তা সম্ভব হবে যদি তারা গণতন্ত্রের প্রতি প্রকৃত অর্থে সম্মানবোধ ধরে রাখে এবং রাজনীতির মাঠে পেশাদার আচরণ করতে পারে। অন্তত এখন বিএনপি’র উচিৎ ষড়যন্ত্র ও উস্কানির পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করা, যা বাংলাদেশের আপামর জনগণের কল্যাণ এবং দেশে একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নিশ্চিত করবে। আর জনগণের রায় নিশ্চয়ই তাদের পক্ষেই যাবে, যাদের প্রতি মানুষ আস্থা আর ভরসা রাখতে পারবে।

লেখক: প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ১৯ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম