বাড়িওয়ালার বোঝা ভাড়াটিয়ার ঘাড়ে

রাজধানীর বাড়িমালিকদের ঘাড়ে নতুন করে চাপিয়ে দেয়া বাড়তি হোল্ডিং ট্যাক্সের বোঝা শেষপর্যন্ত্ম ভাড়াটিয়াদেরই টানতে হচ্ছে। এরইমধ্যে অনেক বাড়িওয়ালাই পুনর্মূল্যায়িত করের টাকা হিসাব করে তাদের বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার কেউবা এ ব্যাপারে ভাড়াটিয়াদের আগাম নোটিশ পাঠিয়েছেন।
বাড়িওয়ালাদের দাবি, হঠাৎ করেই সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই ব্যাংক লোন নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন। ব্যাংকের কিস্তিসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। তাই ভাড়া বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না।

তবে সিটি করপোরেশন সংশিস্নষ্টরা বলছেন, কোনো হোল্ডিংয়েই ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়নি। আগেও বাড়িভাড়ার বার্ষিক ১২% হারে ট্যাক্স নেয়া হতো, এখনো তাই নেয়া হচ্ছে। তবে পরিবর্তন শুধু ভাড়ার ক্ষেত্রে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়। এরপর বাড়িভাড়া বেড়েছে, বেড়েছে ভবনের তলাও। এগুলো জরিপ শেষে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

তাদের মতে, \’৯০ সালে যে বাসার ভাড়া তিন হাজার টাকা ছিল, সেটা এখন ২৫/৩০ হাজার টাকা হয়েছে। বর্তমান ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করে এখন নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ঠিক করা হচ্ছে। এতদিন অনেক বাড়িওয়ালা \’৯০ সালের বাড়িভাড়ার হিসাবে হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়েছেন, এখন থেকে বর্তমান ভাড়ার হিসাবে দেবেন। এটাকে কোনোভাবেই বৃদ্ধি বলা যাবে না।

তবে এই পুনর্মূল্যায়নকেই হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি হিসেবে দেখছেন বাড়ির মালিকরা। ২০১০ সাল থেকে ধানমন্ডির বাড়ির বার্ষিক ট্যাক্স ছিল ১৮ হাজার টাকা। এক দফায় তা বাড়িয়ে এবার সাড়ে ৪২ হাজার টাকা করা হয়েছে। বাড়ির মালিক জানান, একেবারে ২৪ হাজার টাকা ট্যাক্স বৃদ্ধি করা অস্বাভাবিক। হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ করতে হলে বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।

একইভাবে শান্তিনগর এলাকার একটি হোল্ডিংয়ের ট্যাক্স রেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাড়িওয়ালা জানান, আগে তার বাড়ির ট্যাক্স ছিল মাত্র ১০ হাজার টাকা। পুনর্মূল্যায়নের পর তা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়া হঠাৎ করে এই টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবেন। করতে পারবেন না বলে জানান তিনি।

এদিকে, অনেক আগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ রয়েছে ঢাকার বাড়ি মালিকদের বিরম্নদ্ধে। এ নিয়ে ভাড়াটিয়াদের পক্ষ থেকে অভিযোগ এলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতেও চায় না সিটি করপোরেশনও। সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভাড়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের না। এটা মূলত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তৎপরতা শুরম্ন করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৩ এলাকায় এই পুনর্মূল্যায়ন শুরম্ন করে। এরপর ডিএনসিসির পুরো এলাকাতে পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরম্ন হয়। আর ডিএসসিসির বাকি তিনিটি অঞ্চলেও এ কার্যক্রম খুব শিগগির শুরম্ন হবে।

ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা শহরে এমনিতেই ব্যয় অনেক বেশি। সাধারণ জীবনযাপন করেও হিমশিম খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্ত্মিতে পড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের আয়ের প্রায় সিংহভাগই চলে যায় বাড়িভাড়ায়। বছরের শুরম্নতেই একদফা বাড়িভাড়া বৃদ্ধির পর গ্যাস-বিদু্যতের দামও বাড়ানো হয়েছে, চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশচুম্বী। সব মিলিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। আবার নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা কষ্টকর হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন অনেকেই।

আরামবাগ এলাকার ভাড়াটিয় অ্যাডভোকেট শরিফ খান বলেন, প্রতি বছরই বাড়িওয়ালাদের ভাড়া বৃদ্ধি করার প্রবণতা দেখা যায়। গ্যাস, পানি ও বিদু্যতের দাম বাড়লে সবকিছুই চাপিয়ে দেয়া হয় ভাড়াটিয়াদের ওপর। সব যদি এভাবে ভাড়াটিয়াদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে মানুষ চলবে কি করে? সরকারকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের পাশাপাশি বাড়িভাড়ার দিকেও নজর দিতে হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি\’র প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া বলেন, সিটি করপোরেশন ট্যাক্স বৃদ্ধি করছে না। বাসাভাড়া বৃদ্ধি করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এরপরও যদি কেউ তা করেন, সেক্ষেত্রে সরকারের আইন রয়েছে। আইন অনুযায়ী সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন জানান, তিনি চান না নগরবাসীর ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ হোক। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনেরও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর ক্ষমতা নেই। এজন্য সরকারের সিদ্ধান্ত্ম প্রয়োজন। মেয়র বলেন, তবে প্রতি পাঁচ বছর অন্ত্মর হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের একটি নিয়ম রয়েছে, যা এতদিন করা হয়নি। এতে দেখা যাচ্ছে, ২৫ বছর আগে কোনো কোনো বাসার ভাড়া ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ওই বাসার ভাড়া বেড়েছে, যদিও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়েনি। এখন এক্ষেত্রে সেই সমতা আনা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নিলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একজন নাগরিক আদালতের আশ্রয় নেন। এরপর গত বছরের ৯ আগস্ট আদালতের নির্দেশে এ কার্যক্রম স্থগিত করে দুই সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট আদালতের আরেক আদেশে সেই স্থগিতাদেশ উঠে যায়। ফলে নতুন করে পুরোদমে পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম শুরম্ন করে দুই সিটি করপোরেশন। উভয় সিটি করপোরেশনই প্রতিটি হোল্ডিংয়ের মালিকের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দিচ্ছে। সূত্র-যায়যায়দিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, ২০ অক্টোবর  ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি