নারী-পুরুষ সমান অধিকার চাই না

প্রভাষ আমিন
গত বুধবার সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ। তখন ঐ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর মডেল টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান কারো অনুমতি ছাড়াই পরীক্ষার হলে ঢুকে পড়েন। ঢুকে দেখেন এক শিক্ষিকা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত শিক্ষিকার ছবি তোলান এবং সেটি ফেসবুকে দিয়ে দেন।

ফেসবুকে আমাদের যা টেস্ট, তাতে ঘুমন্ত শিক্ষিকার ছবি ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। এই ঘটনায় অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রথম প্রশ্ন হলো একজন উপজেলা চেয়ারম্যান পরীক্ষার হলে ঢুকতে পারেন কিনা? ইকবাল আহমেদ তার ফেসবুকে দাবি করেছেন, ‘উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের স্বার্থে আমি নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন করে থাকি।’

ক্ষমতাবানদের পরীক্ষার হল পরিদর্শন আমাদের অনেক পুরনো সংস্কৃতি। এসএসসি, এইচিএসসির মত পাবলিক পরীক্ষার সময় তো ক্ষমতাবানরা সাংবাদিক এবং দলবল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকে পড়েন। অথচ পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের দরকার অখণ্ড মনোযোগ। আর আমরা দলবল নিয়ে ঢুকে তাদের মনোযোগে ব্যঘাত ঘটাই।

তাই আমি মনে করি, কোনো অজুহাতেই উপজেলা চেয়ারম্যান তো বটেই এমনকি শিক্ষামন্ত্রীরও কোনো পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢোকা উচিত নয়। এরপরের প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষিকা পরীক্ষার হলে ঘুমাতে পারেন কিনা? অবশ্যই পারেন না।

ক্লাশে বা পরীক্ষার হলে একজন শিক্ষককে সদা সতর্ক থাকতে হবে। সেই শিক্ষিকা তার ফেসবুকে দাবি করেছেন, তিনদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। প্রধান শিক্ষকের কাছে ছুটি চেয়েও পাননি। তাই বাধ্য হয়ে স্কুলে এসেছিলেন। পরীক্ষার হলে হঠাৎ তার মাথা ঘুরালে তিনি চেয়ারে বসেন। এক পর্যায়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।

অনেকে বলছেন, এই শিক্ষিকার দাবি সত্যি নয়। তিনি প্রায়শই ক্লাশে ঘুমান। অসুস্থতার জন্যই হোক আর নিয়মিতই হোক, ক্লাশ রুমে ঘুমানোটা ঠিক নয়। দায়িত্বে অবহেলার জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এই ইস্যুতে আরো অনেক অভিযোগ এসেছে। শুধু এই শিক্ষিকাই নন, গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অনেক শিক্ষকই নাকি ক্লাশে এসে ঘুমান, দেরি করে স্কুলে আসেন, এসে আবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। অনেক নারী নাকি তার সন্তান নিয়ে স্কুলে আসেন। শিক্ষার্থীদের দিয়ে ঘরের নানা কাজকর্ম করান।

ফেসবুকে এখন এমন হরেক অভিযোগ। এইসব অনিয়ম দূর করে, প্রাথমিক শিক্ষাকে আরো গতিশীল করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল প্রশ্নে পরে আসছি।

তার আগে পরীক্ষার হলে ঘুমানো নিয়ে আরেকটু কথা বলে নেই। মানুষ মানুষই, রোবট নয়। তার শরীর ভালো থাকবে, খারাপ থাকবে। ভালো শরীরও হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পারে। হুটহাট ঘুমও পেতে পারে। সংসদে মন্ত্রী-এমপিদের ঘুমের দৃশ্য টিভিতে সরাসরি দেখা যায়। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনা সভার মঞ্চেও মন্ত্রী-নেতাদের ঘুমাতে দেখা যায়।

তারপরও আমি মনে করি, পরীক্ষার হলে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি। অসুস্থ হলে তার অবশ্যই ছুটি নেয়া উচিত ছিল। এখন আসি মূল প্রশ্নে। উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ লুকিয়ে লুকিয়ে একজন ঘুমন্ত নারীর কাছে গিয়ে, তার ছবি তুলিয়ে ফেসবুকে দিয়ে ঠিক করেছেন কিনা?

অনেকে বলছেন, একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার স্কুল পরিদর্শন এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে। কিন্তু একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার ক্লাশরুমে ঘুমাচ্ছেন কিনা সেটা দেখার জন্য লোক আছে। কী পরিস্থতিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তার জবাবদিহিতা নেয়ারও নিশ্চয়ই লোক আছে।

কিন্তু একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের কোনো অধিকার নেই গোপনে একজন ঘুমন্ত নারীর ছবি তোলানোর। শুধু ছবি তোলা নয়, একজন ঘুমন্ত নারীর অত কাছে যাওয়াটাও স্বাভাবিক ভদ্রতায় পড়ে না। পরীক্ষার হলে ঘুমিয়ে সেই শিক্ষিকf অবশ্যই তার দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। তার বিচার অবশ্যই হবে। তবে তার আগে বিচার হতে হবে সেই উপজেলা চেয়ারম্যানের।

একজন সম্মানিত শিক্ষিকাকে সামাজিকভাবে অপদস্ত করায় তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা হতে পারে। বিনা অনুমতিতে তোলা ছবি ফেসবুকে দেয়ায় মামলা হতে পারে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায়ও। দুটি মামলা একসাথেই চলতে পারে।

অনেকে বলছেন, ৫৭ ধারা নিয়ে এত আলোচনা হলো, আর আপনি এখন এই ধারায় মামলা চান। অবশ্যই চাই। আমি ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের বিপক্ষে। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীদের হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে ৫৭ ধারার মত একটি ধারা অবশ্যই দরকার। আর এই মামলাটি হবে ৫৭ ধারার সঠিক প্রয়োগ।

অনেকে বলছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঠিক কাজ করেছেন। তার এই উদ্যোগের কারণে সারাদেশের শিক্ষকরা সচেতন হবেন। যত যাই হোক, ক্লাশরুমে ঘুমিয়ে পড়ার শাস্তি নিশ্চয়ই গোপনে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দেয়া নয়। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে তার শাস্তি হতেই পারে।

কিন্তু এভাবে একজন নারীকে সামাজিকভাবে অপদস্ত করার অধিকার কারো নেই, উপজেলা চেয়ারম্যানের তো নয়ই। চিহ্নিত অপরাধী ছাড়া কারো ছবিই গোপনে তোলা ঠিক নয়। আর কোনোভাবেই একজন নারীর ঘুমিয়ে থাকার ছবি আপনি তুলতে পারেন না, ফেসবুকে দিতে পারেন না।

এই শিক্ষক নারী না হয়ে পুরুষ হলেও আমি আপত্তি করতাম। তবে তখন হয়তো, অত জোরালো নয়। অনেকে বলছেন, একজন নারী পরীক্ষার হলে ঘুমালে কি তার ছবি তোলা যাবে না? এই প্রশ্ন যারা করেন, তারা নারীর মর্যাদার বিষয়টি বুঝতে পারেন না। অত সহজে তাদের বোঝানোও যাবে না।

পারিবারিক শিক্ষা থেকে যদি আপনি নারীকে মর্যাদা দিতে না শেখেন, আপনার বোধের ভেতরে যদি বিষয়টি না থাকে; আপনি সহজে বুঝবেনও না। অনেকে বলছেন, আপনারা নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলছেন, আবার নারীর অবমাননায় বেশি সোচ্চার হন কেন?
প্রথম কথা হলো, আমি ব্যক্তিগতভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্য অধিকারে। যার যার প্রাপ্য অধিকার তাকে দিতে হবে। নিক্তি মেপে অধিকার দিলে বঞ্চনা আর বৈষম্য থাকবেই।

যুগ যুগ ধরে পুরুষরা নারীদের দমিয়ে রেখেছে। তাই বিশ্বজুড়েই নারীরা পিছিয়ে আছে। আমি মানুষকে ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে বিবেচনা করি না। মানুষকে আমি শুধু মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে চাই। কিন্তু এখন যদি আমি নারীদের সমান অধিকারের কথা বলি, তাহলে আমরা যে যুগ যুগ ধরে তাদের পিছিয়ে রেখেছি, তারা তো সেই পেছনেই থাকবে।

আগে তারা পুরুষের সমান সমান হোক, নারীর বঞ্চনার ক্ষতিপূরণ হোক; তখন আমি নারী-পুরুষের সমান অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবো।

প্রভাষ আমিন
সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, ২৩ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ