রোহিঙ্গা সংকট : ক্রসফায়ারে বাংলাদেশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি

“No one leaves home unless home is the mouth of a shark.”
― Warsan Shire, Teaching My Mother How to Give Birth
সত্যি তাই, কেউ ঘর ছাড়েনা, ছাড়তে চায়না। শেষ সময় পর্যন্ত মাটি কামড়ে থাকতে চায়। ছাড়ে যখন আর পেরে উঠেনা। গণমাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে অসহায় রোহিঙ্গাদের ছবি কঠিন আত্মাকেও বেদনায় আচ্ছন্ন করে। ভিটে-মাটি ছেড়ে মানুষগুলো অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারের উদ্দেশে পা বাড়িয়ে এসেছে বাংলাদেশে। অবোধ শিশুর কাঁধে শিশু, মা পেছনে আরেক শিশু নিয়ে বন্ধুর পথ পেরিয়ে তারা আমাদের ভূমিতে এলো লাখ লাখ। এলো বয়স্ক নারী-পুরুষ। এরা বাড়ি ঘর ছাড়া হয়েছে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণহত্যা আর সহিংসতায়। প্রায় প্রতিটি পরিবারই স্বজন হারা। রাখাইন ছেড়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের জমিতে তারা প্রাণ হাতে করে এসেছে। মানবিক বাংলাদেশ হাত বাড়িয়েছে চোখে-মুখে এক আকাশ আতঙ্ক নিয়ে আসা এসব মানুষের দিকে।

গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। আসতে গিয়ে নৌকা ডুবে মারা গেছে কত শতজন। নাফ নদীর পানিকে আরো গভীর করে এপারের মানুষ চোখের জলে দেখছে নদীতে ভাসছে শিশুর লাশ, শিশুকে জাপ্টে ধরে রাখা মায়ের লাশ।

সিরিয়ার সংকটে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকট শুরু হলে মানুষের দুর্দশার যে ছবি পৃথিবীকে আলোড়িত করেছিল, আজ যেন পৃথিবী অনেকটাই স্থবির। সংকট যখন চরমে, যখন লাখো মানুষ অত্যাচারী বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনী আর বৌদ্ধ সন্ত্রাসিদের হামলায় পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছিল, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সফরে গেলেন মিয়ানমার। মিয়ানমার নেত্রী চুলে-ফুল-গোঁজা অং সান সুচির সঙ্গে মোদির উষ্ণ ছবি ছড়িয়েছে ইন্টারনেটে।

রাষ্ট্র হিসেবে ভারত মিয়ানমারের সাথে তার লাভের হিসেব করবে এটা স্বাভাবিক, তবে আমাদের সাথে উষ্ণতার খাতিরে আশা করেছিলাম নরেন্দ্র মোদি রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে কিছুটা হলেও বলবেন। রোহিঙ্গাদের যে অংশ অস্ত্র হাতে তুলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল, তিনি তাদের সেই হিংস্রতার নিন্দা করলেন। মিয়ানমারের সুস্থিতি ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। কিন্তু কিছুই বললেন না মিয়ানমার সরকার যে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করছে তা নিয়ে। তবে একথাও সত্য এ মুহূর্তে এখন পর্যন্ত আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ত্রাণ এসেছে এককভাবে ভারত থেকেই।

একাত্তরে এক কোটি বাঙালিকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। আফগান যুদ্ধ যারা শরণার্থী হয়ে এসেছিল তাদেরও গ্রহণ করেছিল ভারত। তিব্বতের বৌদ্ধদের জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার তামিলদের জন্য তামিলনাড়ু ছিল অবাদ বিচরণ ভূমি। সেই ভারত আজ হত দরিদ্র রোহিঙ্গাদের ব্যথা বুঝলোনা?

আমাদের আরেক বিশেষ বন্ধু মাও সেতুং-এর চীন। চীন মিয়ানমারকে দেখে তারই আরেক জমি হিসেবে। তাই যত অপরাধ করুক মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা, যতই মানবাধিকার ধুলোয় মিশিয়ে দিক, চীনের কাছে তারা চোখের মণি। চীনের প্রশ্রয়ে যত ধরনের অনাচার করা সম্ভব করছে সুচির দেশ। সভ্য দুনিয়ার ধারণাটাই আজ পাল্টে দিয়েছে মিয়ানমার। জাতিসংঘে বারবার মিয়ানমারের অত্যাচারের পক্ষে সাফাই গেয়েছে চীন। কারণ একটাই। মানবিকতার চেয়েও ‘সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদি’ চীনের কাছে বড় বিষয় বাণিজ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে বড় অংশীদার মিয়ানমার।

রাজনীতি, কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতি খুব নিষ্ঠুর। তাই মার্কিন প্রতিক্রিয়াও আসে খুব সতর্কভাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না সময় মতো। তবে কিছুটা সরব একমাত্র জাতিসংঘ। মানবিকতার চোখে ঠুলি পরে থাকে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও।

রোহিঙ্গাদের বড় অংশই মুসলামান। কিন্তু চুপ করে আছে মুসলমান দুনিয়াও। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইরান ছাড়া মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে ওআইসি, মুসলিম বিশ্বের বড় মোড়ল সৌদি আরবসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো। ছোট বিকাশমান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার চাপে নিজেরাই পর্যুদস্ত। সেই বাংলাদেশ কি করে লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপ নিবে? কেউ কি সক্রিয়ভাবে বুঝতে চাইলো এই সত্যটি?

সুচি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। তাকে বলা হয় গণতন্ত্রের নেত্রী। এই তার গণতন্ত্র? সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের ঘৃণ্য অত্যাচার তিনি দেখছেন নিরবে। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করা সুচি আজ দেশ চালান সেনাবাহিনীর তাঁবেদার হয়ে। নোবেল বিজয়ীর অমানবিক আচরণের জন্য আজ অন্য নোবেল বিজয়ীরা ক্ষুব্ধ।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সমস্যা বাংলাদেশের নয়। কোন অপরাধ না করেও বাংলাদেশ আজ ভিকটিম। বলতে গেলে, মিয়ানমার সরকারের অমানবিক আচরণ, আঞ্চলিক শক্তি সমূহের বাণিজ্যিক স্বার্থের যে কদর্য লড়াই, তার ক্রসফায়ারে পড়েছে বাংলাদেশ।

সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধান করতে হবে মিয়ানমারকেই। তবে দায়িত্ব আজ পুরো বিশ্বের। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই ক্রমাগত সহিংসতা বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই সাহসী উদ্যোগ নিতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে সমস্যা সমাধান নিজেরা না করলে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ায় যেভাবে আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল, তার বেলায়ও ব্যতিক্রম হবে না।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম