যখন শেখ হাসিনা হত্যা ষড়যন্ত্র প্রকাশে ব্যর্থ হই, মনে হয় মরেও বেঁচে আছি

মতামত সংবাদ

পীর হাবিবুর রহমান
মাঝে মধ্যে মনে হয় সাংবাদিকতা ছেড়ে দিই। রক্তে, অস্থিমজ্জায়, চেতনাজুড়ে সংবাদকর্মীর চরিত্র বইছে। শোলক সন্ধানীর মতো খবরের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছি পেশার তারে জড়ানো রিপোর্টারের জীবন। ডর, ভয় কখনো দমাতে পারেনি। কিন্তু আজকাল কি জানি কি হয়, কোথায় কি ঘটে, কখন কে ক্ষিপ্ত হয়, এ নিয়ে বিচলিত যে থাকি না; তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

লড়তে লড়তে মানুষ ক্লান্ত হয়। কখনো সখনো নানামূখী আঘাত, ঘরে বাইরে নানা ষড়যন্ত্র সকল বিশ্বাস, আবেগ, অনুভূতি ও সাহসের কণ্ঠকে মুঠো চেপে ধরে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সামরিক জামানায়ও জানতাম কি বলতে হবে, কি লিখতে হবে? গণতন্ত্রের জামানায় আজো জানিনা, কি বলতে হবে, কি লিখতে হবে?

শনিবার শরীরটা ভালো লাগছিল না। বিকালের অফিস মিটিংয়ে যোগ দিতে পারিনি। রাত ৮ টায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্ধুবরেষু মঞ্জুরুল ইসলামের আমতন্ত্রে টকশোতে যোগ দিয়েছিলাম। অগ্রজ জাকারিয়া কাজলের সঙ্গে টকশো করতে গিয়েই জানতে পারলাম সেই ভয়ংকর চাঞ্চল্যকর খবর। ভারতের নিউজ১৮ এর সিনিয়র সাংবাদিক সুবীর ভৌমিককের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এবছরের ২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র বানচাল করেছে।

পরিকল্পনাটি নস্যাৎ হয় বাংলাদেশি ও ভারতীয় জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকর্তাদের বুদ্ধিমত্ত্বায়। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রীকে তার অফিসের বাইরে থাকার পরামর্শ দেয় জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকর্তারা। যেখানে একটি আন্তঃবলয় তৈরি করে তার বিশেষ অনুগতরা। তারপর তারা দুর্বৃত্তদের আটক করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপদে অফিসে ফিরে আসার রাস্তা তৈরি করে।

সূত্র অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ১১তম ষড়যন্ত্র। সন্দেহভাজনদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হচেছ।

সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ৬ থেকে ৭ জন বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র নিচ্ছিল। এটি হতো একটি ‘ইনসাইড জব’। যার বাইরে থেকে তাদের সমর্থনে থাকতো জেএমবি। প্রসঙ্গত, জেএমবি একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী। যারা বাংলাদেশে অনেক বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে।

টকশোতে এই চাঞ্চল্যকর, ভয়ংকর সত্য নিয়ে আলোচনার পর বন্ধু মঞ্জুরুল ইসলামের অফিস কক্ষে কফি পান করতে করতে দেখলাম তিনি একের পর এক টেলিফোন ধরছেন, নিউজ ব্ল্যাকআউট করছেন। পূর্বপশ্চিমবিডি।নিউজের সম্পাদক খুজিস্তা নূর ই নাহরীন তিনিও আমাদের নিউজ পোর্টাল থেকে এই খবর ব্ল্যাক আউট করে দিচ্ছেন। আমি নিজেও অনেক টেলিফোনের জবাবদিহিতার মধ্যে পরলাম। এই রকম একটি খবর ব্ল্যাক আউট করতে গিয়ে একজন সংবাদকর্মী হিসাবে এত বছর কাটিয়ে এসে মনে হচ্ছিল, নিজের বুক কাঁটছি।

মধ্য রাতে টেলিভিশন চ্যানেল ৭১ জার্নাল দেখতে গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবুকে অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছা করলো। তিনি এই সংবাদ নিয়ে বিস্তর আলোচনাই করান নি। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার বা সিনিয়র সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে সরাসরি উপস্থাপিকা ফারজানা রূপার টেলিফোন সাক্ষাতকারটিও শুনতে পেলাম। সুবীর ভৌমিক বলছেন, ঘাস কেঁটে তিনি সাংবাদিক হননি। কলকাতায় বসে অনুপ চেটিয়ার গ্রেপ্তারের খবর যেমন আগাম দিয়েছিলেন; তেমনি বিলম্ব হলেও শেখ হাসিনা হত্যার ষড়যন্ত্র বানচালের খবরটি দিয়েছেন সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছিলেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের যোগসূত্রে কিভাবে এই হত্যা ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা হয়েছিল এবং তা বানচাল হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিগত ৯ বছরের শাসনামলে যতগুলি হত্যা ষড়যন্ত্র হয়েছে নানা মহলের নাগরিকগণ সেখানে জড়িত হয়েছিলেন। খুনের পরিকল্পনা যারা করেন তারা সিভিলিয়ানই হোন, সরকারি কর্মকর্তাই হোন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীই হোন, দেহরক্ষীই হোন কিংবা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাসবাদীই হোন তারা সবাই খুনির পাল্লায় উঠেন। এ নিয়ে কারো লজ্জা, গ্লানি বা ব্যর্থতা থাকার কথা নয়। যেকোনো সরকার রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র, হত্যা, খুনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সত্য উদঘাটন এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনাই বড় কথা।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে জঙ্গিবাদের যে উত্থান রাজশাহীর বাগমারাকে স্বাধীন করে নিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেমবির যে নির্দয়তা, নৃশংসতা তার খবর বাংলাদেশের গণমাধ্যম আগাম দিতে পারেনি। মার্কিন দৈনিকের সংবাদকর্মীরা এদেশে এসে দীর্ঘদিন সরেজমিন কাজ করে দুনিয়াকে জানিয়েছিলেন। দুনিয়াকে জানানোর পর আমরা ঘরের সন্তানরা জেনেছিলাম, জানার পর সেই খবর প্রচার করলে সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছিলেন-পরবর্তীতে ফাঁসিতে ঝুঁলে যাওয়া বাংলা ভাইয়েরা মিডিয়ার সৃষ্টি; এই দানবেরা, এই খুনিরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কতটা আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম ও জনমতের কাছে সেই দানবশক্তি পরাস্ত হয়েছে।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে তিনটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ওপর যে আঘাত এসেছে তার নেপথ্য কুশীলব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়নকারীরা, ব্যবহৃত হয়েছে তাদের নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি মাত্র। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীল নকশা অনুযায়ী শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন দিয়েছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সেই নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। কারণ তারা দেশের বাইরে ছিলেন। টানা ৬ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করার পর আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা মুজিবের রক্তাক্ত গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশে ফিরে এসে, দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটে গণআন্দোলনই গড়ে তোলেননি; গণরায় নিয়ে গণতন্ত্রের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। জীবনে ২২ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। ১৯৭৫ ও ১৯৭১ এর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুঁলিয়েছেন।

ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী, ১৯৭১ যার কাছে জাতি হিসাবে আমাদের ঋণী করে রেখেছে সেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে তার বাসভবন থেকে পায়ে হেঁটে দর্শনার্থীদের সাক্ষাত দিতে যাওয়ার সময় ছোটবেলা থেকে যাকে গভীর স্নেহ, মমতায় বড় করেছিলেন সেই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। আত্নঘাতী বোমা হামলায় তার পুত্র ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নির্বাচনী সমাবেশে নিহত হয়েছিলেন। অপঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তারও আগে যুব কংগ্রেস নেতা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া নিজে যেমন ক্ষমতা নেননি, পুত্র রাহুলকেও ক্ষমতা দেননি। রাজনীতিতে দিয়ে আগলে রেখেছেন। অনেকে বলছেন, রাহুলকে দিয়ে হবে না। ইন্দিরা গান্ধীর অবয়ব নিয়ে আসা কন্যা প্রিয়াংকা গান্ধীকে দলের হাল ধরার জন্য দিতে হবে। কিন্তু ঘাতকের বুলেট, বোমা এতটাই উৎকণ্ঠিত করে রেখেছে যে, প্রিয়াংকাকে তিনি এখনো রাজনীতিতে দেননি।

পাকিস্তানের পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাশাসক জিয়াউল হক ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। তার কন্যা, গণতন্ত্রের নেত্রী বেনজীর ভুট্টোকে নির্বাচনী সমাবেশে হত্যা করা হয়েছে। পুত্র মুর্তজা ভুট্টোর লাশ হোটেলে পাওয়া গেছে।

উপমহাদেশের রাজনীতির তিনটি পরিবার মুজিব-ইন্দিরা-ভুট্টো পরিবারকে বুলেট শেষ করে দিয়েছে। শেখ হাসিনা, মুজিব কন্যা হিসাবে বিশ্ব রাজনীতিতে আপন মহিমায়, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের দ্যুতিতে জায়গা করে নিয়েছেন। সেখানে তার দীর্ঘ ৩ যুগের সংগ্রাম মুখর জীবনে ২২ বার হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। পায়ে পায়ে মৃত্যুর সঙ্গে বাস করে বাংলাদেশের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন।

সর্বশেষ ২৪ আগস্ট যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্র নিয়োজিত। নিরাপত্তা সদস্যদের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য নেই। একটি খবরকে ব্ল্যাকআউট করে দেয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। মেজর জিয়া সোর্ড পাওয়া একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনিও শেখ হাসিনা উৎখাতের ষড়যন্ত্রে ছিলেন। একজন মুফতি হান্নান ফাঁসিতে ঝুললেও, একজন জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী ছিলেন। লালদিঘীর ময়দানে গুলিবর্ষণকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। জনগণের রাজনীতির জন্য নিবেদিত প্রাণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রেরই নয়; জনগণেরও রয়েছে। জনগণের নেত্রীকে হত্যার কি ভয়ংকর ষড়যন্ত্র ২৪ আগস্ট ঘটেছিল সে খবর জনসাধারণকে দেয়া সরকারের দায়িত্ব। কারণ রাজনীতিতে, গণতান্ত্রিক সমাজে নানা মত পথ থাকলেও ষড়যন্ত্র ও হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে গোটা দেশের জনগণ রয়েছে। ঘাতক-খুনির সংখ্যা কিংবা ষড়যন্ত্রকারীর সংখ্যা অতি নগন্য, দেশপ্রেমিক জনগণের সংখ্যাই বেশি।

দেশ ও মানুষের জন্য যদি হয় সাংবাদিকতা, সেখানে অনেক সত্য উদঘাটনে ও সত্য প্রকাশে আমরা সংবাদকর্মীরা যেমন সফল তেমনি ব্যর্থতার কলংকের বোঝাও বহন করছি। এমনটি হবার কথা নয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে, গণতান্ত্রিক সমাজে দলবাজি নয়, সমাজের দর্পন হিসাবে গণমাধ্যমকে সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশে নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রাখা জরুরি। এখানে নানা কারণে এতটাই হোঁচট খাই যে, এতটাই ব্যর্থতার গ্লানিতে ডুবে যাই যে, মাঝে মধ্যে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, কিছু কিছু রাজনীতিবিদ বেঁচে আছেন বলে যেমন রাজনীতি করেন, তেমনি বেঁচে আছি বলে সাংবাদিকতা করি। কারণ আর কিছুই শিখিনি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের সত্য প্রকাশে যখন ব্যর্থ হই, মনে হয় মরেও বেঁচে আছি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম