‘এই ক্রিকেটই একটা সময় শূন্য হয়ে যাবে’

‘ক্রিকেট আমার কাছে অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার। ছোট করে উত্তর দেওয়া তো কঠিন। ক্রিকেট খেলেই তো সব হয়েছে আমার। আর ক্রিকেট থেকেই সব পেয়েছি। তবে একটা জায়গায় থামতে হবে জানি। ওই সময়ের পরে এই ক্রিকেটই আবার শূন্য হয়ে যাবে। ১৭ বছর টেনে আসছি, একটা জায়গায় গিয়ে থামতে হবে। তখন এই পার্টটাই শূন্য হয়ে যাবে। তো মাথায় ওটাও সব সময় কাজ করে যে দিনশেষে এটাই জীবন না। আবার এটাই আমাকে সবকিছু দিয়েছে এটাও ঠিক।’

কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথাগুলো বলেন। ক্রিকেট আপনার কাছে কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন তিনি।

সাক্ষাৎকারে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সমস্যা প্রসঙ্গে মাশরাফি বলেন, কৌশলগত বেশি। মানসিক আরও বেশি। আমি বলব মানসিকভাবে বেশি সমস্যা ছিল আমাদের।

ক্রিকেটে আসার গল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্রিকেটে আসার গল্প তো আসলে অনেক বড়। সিজনাল খেলোয়াড় ছিলাম। টেনিস, টেপ টেনিস এসব খেলতাম। বড় ভাইরা খেলতেন, উনারা পুশ করতেন ক্রিকেট বলে আসার জন্য। তারপর অনূর্ধ্ব-১৭ খেলি। প্রথমবারের মতো খুলনা মোহামেডানের হয়ে একটা ম্যাচ খেলতে যাই। আমার নানা সেক্রেটারি ছিলেন তখন। উনাদের খেলোয়াড়স্বল্পতা ছিল। তো আমাকে নিয়ে যান। আর ওই ম্যাচে আমি ছয় উইকেট পাই। তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল। ওটা সম্ভবত ১৯৯৯ অথবা ২০০০ সাল ছিল। যে বছর আমি অনূর্ধ্ব-১৭ খেলি ওই বছরই।

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় প্রসঙ্গে মাশরাফি বলেন, সবচেয়ে বড় বাজে সময়, একটা পার্ট গেল ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়। আর ইনজুরির সময়গুলো সময় অবশ্যই। আর যদি দল, নিজের সবকিছু মিলিয়ে বলেন এখন যে সময়টা যাচ্ছে এটার কথা বলব। এই সময়টা খুবই কঠিন। কারণ, কোনও ফলই আমাদের পক্ষে না। ব্যক্তিগত, দলীয় যাই বলেন, কোনও কিছুই আমাদের পক্ষে না। তবে এই সময়টা অনেকটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। এখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায় এই যে এক্সাইটমেন্ট যাদের মধ্যে কাজ করে তারা কিন্তু অনেক আনন্দ পায়। এই সময়গুলো যারা ওভারকাম করে আসে তাদের মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ কাজ করে। তো এটা যেমন কঠিন, এটার মধ্যে আনন্দও আছে। এটার মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারলে আরও বেশি আনন্দ।

খারাপ সময়ের সাথে ভালো সময় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাল সময় অনেক আছে। বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক ফর্ম যদি ধরেন। দুই-তিন বছরের পারফরম্যান্স, প্রথম টেস্ট ম্যাচ জেতা, ভারতকে হারানো, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি ফাইনালে ওঠা বলতে পারেন। এমন আরও অনেক ভাল লাগার মতো সময় আছে।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ১৭ বছরের তৃপ্তি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমি আমার জীবন নিয়ে তৃপ্ত। আমার আসলে অভিযোগ নেই। কেন জানি একটা সময়ে বাস্তবতা মানা শুরু করেছি নিজের থেকে। খুব কঠিন, শুরুতে মানতে পারতাম না। এখনও কিছু কিছু বিষয়ে খুব জিদ লাগে। মানতে কষ্ট হয়। কিন্তু নিজে যখন স্থির থাকি, নিজেকে আলাদা করে একটু সময় দিই তখন মেনে নিই এটাই বাস্তবতা। প্রত্যেকটা মানুষ এমন ভাল-খারাপের মধ্যে দিয়েই চলে। আল্লাহ যা আমার কপালে রেখেছিলেন সেটাই হয়েছে। তাই আমার কোনও আফসোস নেই।
১৭ বছর পার করে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের। এর মধ্যে অনেকবার ইনজুরিতে পড়েছেন। এই সময়ে এসে কী মনেহয়, এত ইনজুরির কী কারণ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওই তো আগেই বললাম, আমরা এত প্রফেশনাল ছিলাম না। ম্যাচ খেলতাম, আর খেলেই ট্রাভেল করে বাড়ি চলে যেতাম। যে বিশ্রাম নেওয়ার দরকার ছিল, সেটা নেওয়া হয়নি। আমাদের সময় আমরা ছয় বছর পর, ২০০৬ সালে এসে প্রথম জিমনেশিয়াম পাই মিরপুর স্টেডিয়ামে। তার আগে আমাদের সোনাওগাঁও হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো জিম করানোর জন্য। কিন্তু সেটাও মাঝেমধ্যে। ২০০৬ সালে যখন স্টুয়ার্ট কার্পেনিন আসেন, প্রথম আমাদের আর্মি স্টেডিয়ামের জিমে নিয়ে যান। তো বোঝাই যায় ক্যারিয়ার শুরু ২০০১ সালে আর জিম করার ধারণা শুরু হয় ২০০৬ সালে এসে। এর মধ্যে অর্থাৎ, ২০০৬ সালের মধ্যে আমার কয়েকটা ইনজুরি হয়ে গেছে। তবু ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই পাঁচ বছর আমি খুব ফিট ছিলাম। হয়তো বয়সের কারণে ফিট ছিলাম, সেটা হতে পারে। এরপর ২০০৮, ০৯, ১০ ও ২০১১ এই চার বছর পরপর আমার তিনটা অপারেশন হয়। এখান থেকে আমার বলের পেস কমে, আরও অনেক কিছু হয়। তবে ২০১১ থেকে আমি আবার গোছোনো শুরু করি। কিন্তু এটা দেরি হয়ে গেছে তত দিনে। সব মিলিয়ে আমার মনেহয় প্রফেশনালিজম ছিল না। কিন্তু এখন অনূর্ধ্ব-১৬ থেকে ওদের গাইডলাইন থাকে, ওদের ফিজিও, কোচ, ট্রেনার সবকিছু আছে। আমার কাছে মনেহয় আমার ইনজুরির একটা বিরাট কারণ ছিল ট্রাভেলিং করা। খেলা বা অনুশীলন শেষ করে বাড়ি চলে যাওয়া বা দুইদিনের ছুটি পেয়েছি বাড়ি চলে গিয়েছি। এতে যে শারিরিক ঘাটতি হতো ওটা একটা বড় কারণ। আর ভাগ্যের ব্যাপার তো আছেই। এমন তো অনেকেই করছে, কিন্তু ওদের হচ্ছে না।

২০১৯ বিশ্বকাপে নিজের ভাবনা নিয়ে মাশরাফি বলেন, এখনই বলা খুব কঠিন। আমি জীবনে কোনও কিছু টার্গেট করিনি, এখনও করি না। টার্গেট করার সুযোগও নেই আমার। খেলছি, উপভোগ করছি। উপভোগ না করলে ছেড়ে দেব। পারফর্ম করতে থাকলে খেলতে থাকব। এর ভেতরে কোনও কিছু হলে সেটা আলাদা বিষয়। তবে নির্দিষ্ট কোনও টার্গেট নেই। তবে একটা পরিস্কার ধারণা থাকার দরকার। যেন ওই সময়ে সরে যেতে কষ্ট না হয়, সম্মান নিয়ে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি আবার একটু অন্যভাবে ভাবি। টি-টোয়েন্টি থেকে কোনও কিছু না ভেবেই সরে দাঁড়িয়েছি। মনে হলে ছেড়ে দেব। এর জন্য আলাদা করে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে নেই। কারণ আপনি যখন টার্গেট সেট করবেন তখন টার্গেটের আশাতেই থাকবেন। যে কারণে আমি এসব করি না। কখনও করি নাই। খেলাধুলা নিয়ে টার্গেট করার কোনও কারণ দেখি না।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, ০২  নভেম্বর  ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি