খুন হওয়া সেই আজমল কারাগারে!

অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে রাজধানীর কদমতলী থানা পুলিশ। লাশটি পড়ে ছিল ইগলু আইসক্রিম ফ্যাক্টরির সামনের টিনের একটি ছাপড়া ঘরে। মুখমন্ডল ছিল থেঁতলানো। চেনার উপায় ছিল না। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ প্রোফাইল সংগ্রহ করে রাখা হয়। শনাক্ত না হওয়ায় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম লাশ দাফন করে। এর পরই এ খুনে জড়িত সন্দেহে পুলিশ একে একে গ্রেফতার করে পাঁচজনকে। এর মধ্যে তিনজন স্বীকার করে বলেছেন, অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির নাম আজমল হোসেন। তারাই আজমলকে খুন করেছেন।

কিন্তু আজমল খুনের আসল সত্য বেরিয়ে আসে ঘটনার প্রায় তিন বছর পর। আজমলের লাশের ডিএনএ প্রোফাইল তার বাবার প্রোফাইলের সঙ্গে মেলেনি। তদন্তে নাটকীয় মোড় নেয়। পুলিশ নিশ্চিত আজমল খুন হননি। জীবিত আজমলের সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে আজমল আছেন কারাগারে। এক তদন্ত করতে গিয়ে পুুলিশের কাছে এখন আরেক নতুন প্রশ্ন, তাহলে কদমতলীর সেই অজ্ঞাত লাশটি কার? এ বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, খুনের শিকার অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির নাম মজিবর। সে সময় কদমতলী থানায় করা এজাহারে ১১ জনের নাম বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন বাদী এসআই লিটন মিয়া। সেখানে ৫ নম্বরে রয়েছে খুন হওয়া মজিবরের নাম। তিন বছর ধরে মজিবর গুম রয়েছেন বলে কদমতলী এলাকায় চাউর আছে। পুলিশ, কারাগার ও স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মামলার বাদী তৎকালীন কদমতলী থানার এসআই লিটন মিয়া (বিপি-৭৩৯৩০৮৯১৬৪) বর্তমানে রয়েছেন খিলগাঁও থানায়। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘উদ্ধারের পর লাশের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য অনুযায়ী এজাহারে নিহতের সঙ্গে চলাফেরা করা ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।’ নিহতের পরিচয় না পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে চলাফেরাকারীদের নাম কীভাবে এজাহারে এলো- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া মামলার আরেক তদন্ত কর্মকর্তা কৃষ্ণদাস বৈরাগীর (বিপি-৮৩১১১৩৫৬৯১) সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার এসআই মো. রফিকুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার সাবেক এসআই প্রদীপ কুমার কুন্ড (বিপি-৭৪৯২০৮৩৯৪০) বলেন, ‘আমার সময়ে আমি মামলার তদন্ত সঠিক করেছি। এ মুহূর্তে কিছু আর মনে নেই। রিমান্ডে নিয়ে ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ সঠিক নয়।’

জানা গেছে, তিন বছর আগে কথিত ‘খুন’ হওয়া সেই আজমল হোসেন ওরফে ইমরান বর্তমানে জীবিত এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আছেন। ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার হত্যা মামলায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন আজমল। মামলা নম্বর ২০(৮)২০। পরে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। আজমল ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা এলাকার রতন মাঝির ছেলে।

এ বিষয়ে বোরহানউদ্দিন থানার ওসি মোহাম্মদ মাজহারুল আমিন বলেন, ‘বোরহানউদ্দিন থানার একটি হত্যা মামলার সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে আজমলকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়। পরে ভোলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কারাগারে পাঠান।’

এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘দুটি হত্যা মামলার আসামি আজমল হোসেন কারাগারে আছেন। একটি ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার, আরেকটি রাজধানীর কদমতলী থানার হত্যা মামলা। তার বাবা রতন মাঝি।’

পুলিশ ও আদালত সূত্র জানান, আজমল হোসেন নন, বাস্তবে খুন হয়েছেন মজিবর নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু মজিবরকে খুন করার পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে মজিবর গুম হয়েছেন প্রচার করা হয়। এ ছাড়া আজমলের ব্যবহৃত পোশাক মজিবরের লাশের গায়ে পরিয়ে আজমল খুন হয়েছেন বলে প্রচার করা হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করে এবং এজাহারে নিহত মজিবরসহ ১১ জনকে বখাটে, দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে বলে উল্লেখ করে। পরে বিভিন্ন সময় খুনের অভিযোগে এ ১১ জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনজন আজমল হোসেনকে খুন করেছেন বলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে আসামিপক্ষের অভিযোগ, রিমান্ডে ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

২০১৭ সালের মে মাসে খুনের এ ঘটনায় কদমতলী থানায় করা মামলা নম্বর ৬১(৫)১৭।

এ মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামিদের নাম না দিলেও এজাহারে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় ওই কক্ষে অনেক দিন ধরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে থাকতে দেখা গেছে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওই ব্যক্তিকে ঘটনাস্থলসংলগ্ন ঢাকা মেস এলাকায় ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মহিম, কালা সুমন, বিল্লাল, জালাল, মজিবর, শুভ, জুয়েল, সোহেল, আমির, কামরুল, বিল্লাল হোসেন (২)সহ আরও চার-পাঁচ জনের সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা যেত। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ মৃত ব্যক্তির নাম এবং ঠিকানা বলতে পারেননি। গোপন অনুসন্ধানে আরও জানতে পারি, মৃত ব্যক্তি যাদের সঙ্গে মিশতেন তারা সবাই এলাকার বখাটে, দুষ্ট প্রকৃতির ও খারাপ ছেলে হিসেবে পরিচিত। এদের সঙ্গে একাধিকবার মনোমালিন্যও হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ-সাত দিন ধরে এলাকায় এদের হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে না। ধারণা করা হয়, পরস্পর যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে শ্বাস রোধে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে।

:বাংলাদেশ প্রতিদিন