ঢাবি শিক্ষার্থী সুমাইয়ার জীবনে আত্মনির্ভরশীলতার স্বপ্নই কাল হলো

শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে থাকায় অন্যদের চেয়ে স্বপ্নও ছিল বড়। স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে জীবন গড়ার তাগিদ থেকেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হয়েছিলেন যশোরের মেয়ে সুমাইয়া বেগম। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে আত্মনির্ভরশীল হওয়াই ছিল তার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নই কাল মেধাবী এই ছাত্রীর জীবনে।

‘মেয়ে সুমাইয়া বেগম অসুস্থ’, সোমবার মুঠোফোনে বেয়াই এমন সংবাদ দিলে যশোর থেকে নাটোর আধুনিক হাসপাতালে ছুটে আসেন মা নুজহাত বেগম। এসে দেখলেন, হাসপাতালের মর্গে মেয়ের লাশ পড়ে আছে। শ্বশুর, স্বামী বা ওই পরিবারের কেউই সেখানে নেই। নুজহাতের অভিযোগ, নির্যাতন করে সুমাইয়াকে হত্যা করেছে স্বামীর বাড়ির লোকজন।

নিহত সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করেছে। উচ্চশিক্ষিত এই নারী আরেকটু মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে প্রস্ততি নিচ্ছিলেন বিসিএস পরীক্ষার। সুমাইয়া গৃহবধূ হয়েও পড়াশুনা চালিয়ে যাক, তা চাইতো না স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ দিকে, সুমাইয়ার বাবা বেঁচে নেই। আছেন মা নুজহাত বেগম ও ভাই সালাহ উদ্দীন।
জানা যায়, সোমবার শ্বশুরবাড়ি থেকে সুমাইয়ার লাশ উদ্ধারের পর সে ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে প্রচার করা হয়। এই প্রচারের জোরেই সারাদিন অতিবাহিত হয় থানায় কোনো অভিযোগ দায়ের হওয়া ছাড়াই। পুলিশ তাই অপমৃত্যু হিসেবেই এই ঘটনার রেকর্ড রাখে।

কিন্তু সাবেক এই শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পেরে তৎপরতা শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এজিএস ও ইউনিট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবিতে বিভিন্ন সূত্রে তৎপরতা শুরু করা হয়।

সাদ্দাম হোসেনের তৎপরতা সম্পর্কে ঢাবিস্থ নাটোর জেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির সহ-সম্পাদক ইব্রাহীম
খলিল নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘সোমবার থেকেই এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে চান ডাকসু এজিএস সাদ্দাম হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা শুনে একাত্মতা পোষণ করেন এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতে সুমাইয়ার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।”

সোমবার সকালে স্বামীর বাড়ি থেকে মৃত অবস্থায় নাটোর সদর হাসপাতালে আনা হয় সুমাইয়াকে। এরপর সুমাইয়া গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করা হয় মোস্তাকের পরিবার থেকে।
তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুমাইয়ার মা নুজহাত এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করেন। এ ঘটনা দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।

সোমবার (২২ জুন) মধ্যরাতে সুমাইয়ার মা নুজহাত হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে এ মৃত্যুর ঘটনায় সুমাইয়ার বাবার বাড়ির কেউ অভিযোগ না করায় পুলিশ ইউডি মামলা করে, পাশাপাশি রাতেই একজনকে গ্রেফতার করে তারা।

মঙ্গলবার (২৩ জুন) সকালে এ ঘটনার পর সুমাইয়ার চাচা মোহাম্মদ আলী জানান, রাত ১টার দিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাড়িতে এসে মামলা করার কথা বলেন। পরে সুমাইয়ার মা নুজহাত ৪ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন।’

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল নাটোর শহরের হরিশপুর এলাকার মোস্তাকের সঙ্গে সুমাইয়ার বিয়ে হয়। এরপর বেশ কয়েকবার শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা নেন মোস্তাক। এমনকি বাড়ির আসবাবপত্র সব কিছু সুমাইয়ার বাবা কিনে দেন মেয়ের সংসারে। গত ৮ মাস আগে সুমাইয়ার বাবা বিশিষ্ট ইসলামী বক্তা সিদ্দিকুর রহমান যশোরী মারা যান। তার মৃত্যুর পরও জামাতা মোস্তাক টাকা চাওয়া অব্যাহত রাখেন। এতে পরিবারের উপর চাপ কমাতে কাউকে কিছু না বলে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন সুমাইয়া।

নিজেই আয় করে স্বামীর পরিবারকে সহযোগিতা করবেন এমনই ভাবনা ছিল তার। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেনি তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তাই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সুমাইয়ার মা নুজহাত বেগম ও ভাই সালাহ উদ্দিন জানান, সুমাইয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়েছে। পরবর্তীতে সন্ধ্যার দিকে তারা নিশ্চিত হন এটা হত্যা।

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, “প্রথমে এই ঘটনায় সুমাইয়ার পরিবার থেকে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। তাই নিয়মানুযায়ী পুলিশের পক্ষ থেকে অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে সুমাইয়ার পরিবার থেকে হত্যার অভিযোগ করা হয়। তাই হত্যা মামলা নেয়া হয়েছে।

মামলায় অভিযুক্ত শাশুড়ি সৈয়দা মালেকা ও ননদ জাকিয়া জুথিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এজিএস ও ইউনিট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন জানান, আত্মনির্ভরতার যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জীবদ্দশায় তাকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছি। আশা করছি পুলিশ এ ঘটনায় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় আমরা বিচারের দাবিতে সোচ্চার হবো।”

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারীর আত্মনির্ভরতা অর্জন যখন খুবই প্রয়োজন, তখন এই ধরণের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা দোষীদের রেহাই দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া অপরাধটি উৎসাহিত করার শামিল। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীকেও তার অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। তা না হলে অনেক সুমাইয়া হবে এরুপ ঘটনার শিকার- এমনটাই মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।