করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে কাল থেকে লকডাউনে সারাদেশ!

গত বছর সরকার করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। এবার কোনো সাধারণ ছুটি নয়, সরাসরি এক সপ্তাহের জন্য শুরু হতে যাচ্ছে ‘লকডাউন’। করোনার সংক্রমণ দেশে ফের বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ‘আপাতত’ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যা আগামীকাল সোমবার থেকে কার্যকর হবে।

সূত্রের খবরে জানা যায়, লকডাউন চলাকালে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে।

অভ্যন্তরীন রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে লকডাউন চলাকালে; বন্ধ থাকবে বাস, ট্রেন ও লঞ্চসহ সব গণপরিবহন; বন্ধ থাকবে শপিংমল, দোকানপাট। শুধু জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার ও শিল্পকারখানা খোলা থাকবে সীমিত পরিসরে, স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে। এ ছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি অফিসে আজ রবিবার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারি উপস্থিত থাকতে পারবেন। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও প্রয়োজন সাপেক্ষে খুবই সীমিত পরিসরে খোলা রাখা যাবে।

লকডাউন চলাকালে দেশের ব্যাংকখাত কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে গতকাল কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আজ রবিবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।

গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, কীভাবে ব্যাংক চলবে সে নির্দেশনা আসবে কাল (রবিবার)। লকডাউনের বিষয়টি সরকার ছুটির দিনে ঘোষণা করেছে। আজ (শনিবার) সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় আগামীকাল রবিবার আমরা সিদ্ধান্ত জানাতে পারবো।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে গতকাল শনিবার বিকাল ৪টায় জুম অ্যাপসের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপ্তির বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দুই সপ্তাহের লকডাউন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পরে সর্বসম্মতিক্রমে আপাতত এক সপ্তাহের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লকডাউনের ধরন কেমন হবে, বৈঠকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। সে ক্ষেত্রে আজ রবিবার জারি করার কথা রয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিবের একান্ত সচিব মাহমুদ ইবনে কাসেম জানান, জুম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং সচিবরা অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, তিন বাহিনীর প্রতিনিধি, পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিজিবি মহাপরিচালক, আনসারের মহাপরিচালকসহ চার গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দুই সপ্তাহের লকডাউন দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও সর্বসম্মতিক্রমে এক সপ্তাহের লকডাউন সমর্থন করা হয়। এ সংক্রান্ত সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলেই লকডাউন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, করোনা মোকাবিলায় এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলাচল কঠোরভাবে সীমিত করা হচ্ছে। জরুরি সেবা (বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, টেলিফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি) লকডাউনের আওতার বাইরে থাকবে। এ ছাড়া কৃষিপণ্য, সার, কীটনাশক, জ্বালানি, সংবাদপত্র, খাদ্য, শিল্পপণ্য, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, জরুরি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন এবং কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান ও হাসপাতাল লকডাউনের মধ্যে পড়বে না।

এর আগে গতকাল জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এক ভিডিওবার্তায় জানিয়েছিলেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দু-একদিনের মধ্যেই এক সপ্তাহের লকডাউন দেওয়া হবে। এ সময়ে জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিফটিং (পালা ক্রমে) ভিত্তিতে চলবে।

একই দিন এরও আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরই প্রথম গণমাধ্যমকে জানান যে, ‘লকডাউন’ দিতে যাচ্ছে সরকার।

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, লকডাউনে আগের মতো সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে শুধু ত্রাণ কিংবা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ ট্রেন চালানো হবে। এ জন্য বিশেষ ট্রেন প্রস্তুত রাখা হবে।

অন্যদিকে লকডাউন চলাকালে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় ফ্লাইট চলবে। গতকাল শনিবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, লকডাউন বিধির ওপর ভিত্তি করে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বেবিচকের পক্ষ থেকেও একটি নোটিশ জারি করা হবে। আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

দোকানে দোকানে ক্রেতার ভিড়, টার্মিনালগুলোতে যাত্রীর লকডাউন ঘোষণার খবরে গতকাল রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে মানুষের অতিরিক্ত ভিড় দেখা গেছে। সরকার লকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ায় যাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। অনেকেই মনে করছেন, সামনে হয়তো পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়ি ফিরে যাওয়া কষ্টকর হবে। তাই এখনই গ্রামে ফিরে যাওয়া দরকার। তাদের অনেকে টিকিটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন টার্মিনালগুলোতে।

অন্যদিকে লকডাউনের খবরে গতকাল রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজারগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় অনেক বেড়ে যায়। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলুসহ বিভিন্ন নিত্য ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে দোকানে দোকানে ছিল ক্রেতাদের ভিড়।

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এর পর ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এর পর পরিস্থিতি বিবেচনায় ছয় দফায় টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিতে থাকে বাংলাদেশ। পরে ৩১ মের পর থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ শিথিল করতে থাকে সরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এখন আপাতত এক সপ্তাহের লকডাউনে গেলেও লকডাউন আরও দুই-এক সপ্তাহ গড়াতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সরকার এসব সিদ্ধান্ত নেবে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীও জানালেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে লকডাউন বাড়ানোর বিষয়ে পরবর্তী সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এর আগে দেশে ফের করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত ২৯ মার্চ ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। এগুলো হলো :-

*এক > সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ যে কোনো উপলক্ষে জনসমাগম সীমিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে উচ্চ সংক্রমণ এলাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে;

*দুই.> মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে;

*তিন > পর্যটন, বিনোদনকেন্দ্র, সিনেমা হল, থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলার আয়োজন নিরুৎসাহিত করা হবে;

*চার > গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না;

*পাঁচ > সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে;

*ছয় > বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে;

*সাত > নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের দোকান খোলা থাকবে এবং উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা চলতে পারে;

*আট > স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;

*নয় > শপিংমলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক;

*দশ > দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে;

*এগারো > অপ্রয়োজনে রাত ১০টার পর ঘর থেকে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;

*বারো > প্রয়োজনে বাইরে গেলে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক না পরলে বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে;

*তেরো > করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বা করোনার লক্ষণ রয়েছে- এমন ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে;

*চৌদ্দ > জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি- বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা, অসুস্থ, ৫৫ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তির বাসায় থেকে কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;

*পনেরো > সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজন করতে হবে;

*ষোলো > সশরীরে উপস্থিত হতে হয় এমন যে কোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;

*সতেরো > হোটেল, রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষ প্রবেশ করতে পারবে এবং

*আঠারো > কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও অবস্থানের পুরোটা সময়ই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।