অযত্নে হারিয়ে যাচ্ছে ভবানীপুর জমিদার বাড়ি

ইতিহাস হল মানুষের অতীত ঘটনা ও কার্যাবলীর অধ্যয়ন। বৃহৎ একটি বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এটি কখনও মানবিক বিজ্ঞান এবং কখনও বা সামাজিক বিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে আলোচিত হয়েছে। অনেকেই ইতিহাসকে মানবিক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখেন।

কালের বিবর্তনে পুরাতন দেয়ালের পলেস্তারা উঠে গেছে। ধসে পড়েছে ছাদ-দেয়াল। তবুও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আজও জানান দিচ্ছে ঐতিহ্যের ইতিকথা। মনে হয় যেন দেয়ালে কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে প্রাসাদের ব্যস্ত দাস-দাসীদের কথা। অথবা তাদের চলাচল থেকে সৃষ্ট পায়ের শব্দ। হাঁসি বা কান্নার আওয়াজ। অবহেলায়-অযত্নে ইতিহাসের পাতা থেকেও হারিয়ে যেতে বসেছে এমন একটি জমিদার বাড়ি।

নওগাঁ শহর হতে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে শাহাগোলা ইউনিয়নের ভবানীপুর জমিদার বাড়ি। এলাকার মানুষের কাছে ভবানীপুর রাজবাড়ি বলেই পরিচিত। ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির পেছনের অংশে এখনো বসবাস করছেন কুমার প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরীর স্ত্রী চিত্রা চৌধুরী, ছেলে অভিজিৎ চৌধুরী, মেয়ে স্নেহা চৌধুরী, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনি।

প্রাতাপ শঙ্কর চৌধুরীর ছেলে অভিজিৎ শঙ্কর চৌধুরী ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, জমিদার পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন রঘুরামশূর চৌধুরী তার স্ত্রী দূর্গাময়ী তিনি নাটোরের শূর বংশের সন্তান। তিনি ভবানীপুরে এসেছিলেন রাজত্বের কাজে। এলাকাটি তার পছন্দ হওয়ায় ভবানীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাড়ি নির্মাণ করেন ও পরবর্তী সময়ে জমিদারি পত্তন করেন।

এদের সন্তান কালীনাথ চৌধুরী। কালীনাথ চৌধুরীর দুই স্ত্রী রাজলক্ষী ও বসন্ত কুমারী। বসন্ত কুমারীর সন্তান গ্রিরিজা শঙ্কর চৌধুরী। জমিদার গ্রিরিজা শঙ্কর চৌধুরীর সময় জমিদারির উৎকর্ষা সাধিত হয়। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করে জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল লাবন্যপ্রভা চৌধুরানী। তাদের ছিল ৬ ছেলে ও ৬ মেয়ে। ছেলে প্রনব শঙ্কর চৌধুরী, পদ্যুত শঙ্কর চৌধুরী, প্রভাত শঙ্কর চৌধুরী, প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরী, প্রবীর শঙ্কর চৌধুরী ও প্রশান্ত শঙ্কর চৌধুরী। মেয়ে আলো রানী, জ্যোৎস্না রানী, কৃষ্ণা রানী, সুপ্রিয়া রানী, প্রভাতী রানী ও বাসবী রানী। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর আমলে জমিদারির ব্যাপক বিস্তারও ঘটে। তিনি কারুকার্য মন্ডিত মন্দির, নাটমন্দির প্রতিষ্ঠা, ভবানীপুর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, ফুল ও ফলের বাগান, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট নিবারণে প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী ও তার জমিদারি এলাকাগুলোয় অনেক জলাশয় ও পুকুর খনন করেন।

১৯১০ সালে জমিদার পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে স্কুলটির নাম জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরীর বাবা গ্রিরিজা শঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর জিএস উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৫৮ সালের দিকে জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী সপরিবারে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তার চতুর্থ ছেলে কুমার প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরী কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। পরে জমিদার প্রিয় শঙ্কর চৌধুরী ছেলে প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরীকে রেখেই কলকাতায় চলে যান। অনেক পড়ে প্রতাপ শঙ্কর চৌধুরী একটু বেশি বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজাহীর মেয়ে চিত্রা চৌধুরীর সাথে।

এই দম্পতির সংসারে আসে এক ছেলে ও এক মেয়ে। পরে তিনি হাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রয়ারি মারা যান। বর্তমানে তার ছেলে অভিজিৎ চৌধুরী এই জমিদার প্রসাদের এক অংশে জরাজীর্ণ ভবনে বসবাস করে আসছেন। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে জমিদারের ধ্বংস প্রায় সুবিশাল অট্টালিকা। জমিদারির আমলে এ রাজবাড়ির মূল ফটকের গেটে ছিল দুইজন নেপালী প্রহরী। এই জমিদারদের অনেক সম্পত্তি ঢাকা, বগুড়া ও দিনাজপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বলে অভিজিৎ শঙ্কর জানান।

নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান জানান, জমিদার বাড়িতে একটি বড় লাইব্রেরি ছিল। সেখানে খ্যাতনামা লেখকদের লেখা গ্রন্থে পরিপূর্ণ ছিল। দ্বিতল ও তৃতীয় তলা কয়েকটি ভবন সমন্বয়ে ছিল মূল প্রাসাদ। প্রতিটি ভবনের সামনে ছিল বিশাল আঙিনা। এখনো প্রাসাদের যেটুকু দাঁড়িয়ে আছে সেটুকুতেই জমিদারদের রুচির পরিচয় বহন করে। ছিল অসংখ্য ঘর। কাছারী বাড়ি। ছিল তিনটি নিজস্ব মন্দির দূর্গামন্দির, গোপিনাথ মন্দির, বাসন্তি মন্দির। তাদের কুলদেবতা গোপিনাথ। একজন স্থায়ী পুরোহিত নিয়োজিত ছিলেন। নিয়মিত হতো পূজা-অর্চনা। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায় শোনা যেতো শঙ্খের ধ্বনি, গীতাপাঠ ও পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারন।

এদিকে দিনে দিনে জমিদার বাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যাচ্ছে। প্রাসাদের মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরি হওয়ার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা-অযত্নে ধ্বংসের দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়িতে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দেখতে আসে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল অট্টালিকা। সুবিশাল প্রাসাদ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।