যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের ১৭ প্রকল্প: ক্ষতিপূরণ আদায়ের বদলে বিল দিতে উৎসাহী গণপূর্ত

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকে বিল্ডার্স তাদের চলমান ১৭টি প্রকল্পের সব কটির কাজ বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া সরকারের সংস্থা বারবার তাগাদা দিলেও তারা আর কাজে নামেনি। একটা পর্যায়ে এসে সরকার সব প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করে নিয়মানুযায়ী অন্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাজ শেষ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু জিকে বিল্ডার্স কাজ এগিয়ে না রাখায় ১৭টি প্রকল্পের বেশির ভাগেরই ব্যয় ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। দু-একটা প্রতিষ্ঠানে অবশ্য ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ হয়ে যাওয়ায় ব্যয় তেমনভাবে বাড়বে না।

এদিকে চুক্তি বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত জিকে বিল্ডার্স ১৭টি প্রকল্পে যতটুকু কাজ করেছে, সেই কাজ পরিমাপ করে টাকা পরিশোধ করতে যতটা তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ থাকায় সরকারের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো তৎপরতা নেই গণপূর্ত অধিদপ্তরের। একটি প্রকল্পে ৩০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে পরিমাপ করে সব টাকাই জিকে বিল্ডার্সকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। কিভাবে ওই কাজের পরিমাপ করা যায়, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১৪ সালের রেট শিডিউলে (দাম প্রস্তাবে) যেসব প্রকল্পে কাজ পেয়েছিল জিকে বিল্ডার্স, সেসব প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ। আবার প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ছে এক থেকে দুই বছর। আর নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া থেকে পিছিয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন জনগণ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারকেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে।

কাজ বন্ধ থাকার কারণে প্রকল্পে বাড়তি যে টাকা খরচ হবে, জিকে বিল্ডার্স থেকে সেই টাকা আদায়ের কোনো জোরালো তৎপরতা নেই। যদিও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে ‘সিকিউরিটি মানি’ রাখা আছে। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে কেটে রাখা হবে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘সিকিউরিটি মানি’ যেটা রাখা আছে, প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে তার চেয়েও বেশি। সে ক্ষেত্রে দিন শেষে সরকারকেই এই টাকা গুনতে হবে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে এক বছর কাজ বন্ধ থাকায় কিভাবে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ হলো রাজধানীর শেরেবাংলানগরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পাশে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি। দুই বছর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় যখন প্রকল্পটি অনুমোদন পায়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২০ কোটি টাকা। ১২ তলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনটি নির্মাণের কাজ পায় জিকে বিল্ডার্স। গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার তিন দিন পর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জিকে বিল্ডার্স কাজটি করছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০১৪ সালের রেট শিডিউলের আলোকে।

এখন চলছে ২০১৮-এর রেট শিডিউল। নতুন করে প্রকল্পটির খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ খরচ বেড়েছে ৪০ কোটি টাকা, যা প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি। আর প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে দুই বছর। জিকে বিল্ডার্সের গাফিলতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রকল্পের এই ব্যয় বাড়লেও বাড়তি টাকা জনগণের দেওয়া কর থেকে বা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘কন্ডিশন অব কন্ট্রাক্ট’ বা চুক্তিপত্রের শর্তাবলিতে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হলে বাড়তি যে টাকা খরচ হবে, সেই টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।’

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে জিকে বিল্ডার্সের যে ৩০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলা হচ্ছে, এই খরচ নির্ধারণ হলো কিভাবে? এখানে কি বুয়েটসহ কারিগরি বিশেষজ্ঞ কেউ উপস্থিত ছিলেন? ম্যাজিস্ট্রেট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তার সমন্বয়ে যে খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে, এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, জিকে বিল্ডার্স ১০ মাস কাজ বন্ধ করে সরকারের যে সময় নষ্ট করেছে, সরকার চাইলে সে জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। তা ছাড়া যে সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে হয়নি, এখন প্রকল্পে বাড়তি যে টাকা খরচ হবে সরকার চাইলে সেই ক্ষতিপূরণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে পারবে। কারণ ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিপত্রে তা স্পষ্ট করে বলা আছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খায়রুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি মানি রাখা আছে। সেখান থেকে নেওয়া যাবে।’

সরকারের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জিকে বিল্ডার্স নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের মূল ভবনের মাটি খনন কাজ শুরু করে ড্রেসিং লেভেল পর্যন্ত ২০ ফুট মাটি কাটার কাজ শেষ করে। বেজমেন্টের ম্যাটের ৩০ শতাংশ ঢালাই কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর গণপূর্ত অধিদপ্তর পুনরায় দরপত্র প্রক্রিয়ায় যেতে জিকে বিল্ডার্স কতটুকু কাজ করেছে তা পরিমাপের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, প্রশাসন ক্যাডারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান—এই তিন প্রতিনিধি যাচাই-বাছাই করে দেখেছে এই প্রকল্পে ৩০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে এবং সব টাকাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে।

একাধিক ক্রয়বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের কাজে যখন পরিমাপ করা হয়, সেখানে প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে হয়। কারিগরি ব্যক্তি নিয়োগ দিতে হয়।

স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জি কে শামীমের সঙ্গে সব প্রকল্পে চুক্তি বাতিল হয়েছে। এর পরও যদি কোনো অনিয়ম হয়, আপনি লেখেন। অনিয়ম যদি সত্যি হয়, আমরা ব্যবস্থা নেব।’

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ডা. বদরুল আলম বলেন, ‘প্রায় এক বছর ধরে আমাদের হাসপাতাল নির্মাণের কাজটি বন্ধ। জিকে বিল্ডার্সকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হয়। তার পরও তারা কাজ করেনি। এই কারণে প্রকল্পের খরচ ৪০ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। মেয়াদও বেড়েছে আরো দুই বছর।’ তিনি বলেন, এই প্রকল্পে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার মতো সিকিউরিটি মানি রাখা আছে। সরকার চাইলে বাড়তি যে টাকা খরচ হচ্ছে, সেখান থেকে কেটে রাখতে পারে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জিকে বিল্ডার্স সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ১৭টি প্রকল্পের কাজ পেয়েছে এককভাবে। যেগুলোর আর্থিক মূল্য এক হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণ, বেইলি রোডের চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক্টস কমপ্লেক্স ভবনে চেয়ারম্যানের বাসভবন, ডরমিটরি, প্রশাসনিক ভবন ও হল নির্মাণ, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের অফিস ভবন নির্মাণ, সচিবালয়ের ২০ তলা ভবনের স্যানিটারি ও বৈদ্যুতিক কাজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বর্ধিতকরণ কাজ, আজিমপুর কলোনিতে সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট নির্মাণ, সচিবালয়ের ২০ তলা ভবনের কাজ, শেরেবাংলানগরে নিটোরে বাউন্ডারি ওয়াল ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ, র‌্যাব সদর দপ্তর কমপ্লেক্সের কাজ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের কাজ, এনবিআর ভবনের কাজ এবং মহাখালীর অ্যাজমা সেন্টারের কাজ।

অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জিকে বিল্ডার্সের পাওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত কাজ হয় ৩৫ শতাংশ। আর আর্থিক খরচ হয় ২৯ শতাংশ। এই প্রকল্পের পুনঃ দরপত্র আহ্বানের জন্য কতটুকু কাজ হয়েছে, তা পরিমাপ করে ঠিকাদারের টাকা পরিশোধ করতে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য বলছে, প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক্টস কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ বন্ধ হওয়ার আগে ভৌত কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। আর আর্থিক খরচ হয়েছে ৫৬ শতাংশ। এই প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে। আজিমপুর কলোনিতে সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পটির ভৌত কাজ শূন্য। আর্থিক কাজও শূন্য। ফলে এই প্রকল্পেও ব্যয় বাড়ছে। একই সঙ্গে মেয়াদও। উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তর কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৭ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৬ শতাংশ। ফলে এই প্রকল্পেও ব্যয় ও মেয়াদ দুটিই বাড়ছে।

এদিকে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজিমপুর সরকারি কলোনিতে বহুতল ভবন নির্মাণের চুক্তি বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিট উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেছেন হাইকোর্ট। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এসব প্রকল্পে আর কাজ পাবে না। কারণ তিনবার নোটিশ দেওয়া, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ সব প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।