প্রতিবন্ধী শনাক্ত, সুবর্ণ কার্ড ও ভাতা দিতে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ: টিআইবি

সুবর্ণ কার্ড ও ভাতা দেওয়া এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শনাক্তের ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়অর অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। জরিপে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত না করা, অধিকাংশ জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা “অনেক ব্যস্ত” থাকায় প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করতে সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত ‘উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধিতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার (গবেষণা ও পলিসি) ফারহানা রহমান।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং তার সহকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে এক থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক “অনেক ব্যস্ত” থাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। উপজেলা/শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে তথ্যভাণ্ডারে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি বা তার নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে ১০০-২০০ টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করা হয়।

স্থানীয় সংসদ সদস্য, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ তাদের প্রতিবন্ধী নন এমন আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের সুবর্ণ কার্ড দিতে সমাজসেবা কার্যালয়ে তদবির করে। যাদের সুবর্ণ কার্ড দেওয়ার কথা নয়, তদবিরের মাধ্যমে তাদের কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা সুবর্ণ কার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সুবর্ণ কার্ড করার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে গেলে নাজেহাল হতে হয় বলেও অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো সেবাগ্রহীতা। অনেক সময় সমাজসেবা কার্যালয়ের লোকজন ফরম ছিঁড়ে ফেলেন এবং সার্ভার নষ্ট হওয়ার অজুহাত দেখান। এমন অভিযোগও আছে যে অতি দরিদ্র প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তির কাছ থেকেও কোনো কোনো কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ৪০০-৫০০ টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে আদায় করেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বিরুদ্ধে সুবর্ণ কার্ডের জন্য এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। আবার সুবর্ণ কার্ড থাকা সত্ত্বেও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া এবং প্রাপ্য সুবিধা পেতে মধ্যস্থতা করার অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবন্ধী ভাতা সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের স্বদিচ্ছার ওপর। ভাতা প্রাপ্তির কার্ড পেতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের একাংশ কর্তৃক প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কাছ থেকে এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। টিআইবি পরিচালিত সেবাখাতে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ এর তথ্য বিশ্লেষণ অনুযায়ী ২৩.৪ শতাংশ খানাকে ভাতায় অন্তর্ভুক্ত হতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ দিতে হয়েছে।

এছাড়া সময়ক্ষেপণ, স্বজনপ্রীতির ও প্রতারণার শিকার যথাক্রমে ১৯.৩ শতাংশ খানা, স্বজন প্রীতি ১১ শতাংশ খানা এবং প্রতারণা শিকার হয়েছেন ৭.৯ শতাংশ খানা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার ৫.২ শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের ভাতার অর্থ আত্মসাতের শিকার ৪.৮ শতাংশ খানা ও ঘুষ দাবি করা হয়েছে ২.৭ শতাংশ খানার কাছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে যে নতুন দুই লাখ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছেন, ক্ষেত্র বিশেষে তাদের ভাতার অর্থের অংশ বিশেষ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবার ভাতার বইয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে বিধায় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তির প্রথম কিস্তি পেতে ২৪ থেকে -৬৭ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ হয়ে থাকে।

সেবার খাতভেদে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি দুর্নীতির শিকার
টিআইবি পরিচালিত সেবাখাতে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ এর তথ্য বিশ্লেষণ অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা তাদের অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মতো সব সেবা নিতেই অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ সব ক্ষেত্রেই তারা কম-বেশি দুর্নীতির শিকার হন। উপবৃত্তির তালিকাভুক্তি, বই প্রাপ্তি, ভর্তি/পুনঃভর্তি প্রবেশপত্র দিতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১১.৩ শতাংশ খানা, ঘুষের শিকার হয়েছেন ৮ শতাংশ ও গড় ঘুষ দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা। স্বাস্থ্য সেবার টিকিট কেনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, শয্যা, হুইল চেয়ার ব্যবহার ও ওষুধ কেনায় দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১৩.৬ শতাংশ পরিবার, ঘুষের শিকার হয়েছেন ৫.৫ শতাংশ ও গড় ঘুষ দিয়েছেন ২৩৬ টাকা। বিভিন্ন ধরনের সনদ ও প্রত্যয়নপত্র ভাতা ও সালিশ গ্রহণে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৩৪ . ৭ শতাংশ, ঘুষের শিকার হয়েছেন ১.৭ শতাংশ। ব্যাংক থেকে ভাতা ও রেমিটেন্স উত্তোলনে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৪.২ শতাংশ, ঘুষ দিয়েছেন ১.৭ শতাংশ খানা। সমাজসেবা কার্যালয়ে শনাক্তকরণ ও সুবর্ণ কার্ড পেতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১৭.৪ শতাংশ খানা ও ঘুষ দিয়েছেন ৮.৭ শতাংশ খানা।

পরিবহন ভাড়া সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন প্রতিবন্ধীরা।

বিভিন্ন এনজিওর অনুদান সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন এনজিও আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। সাহায্যপ্রাপ্ত এনজিওগুলোর একাংশ ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশের মাধ্যমে অনুদান পেয়ে থাকে। অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০,০০০-৭০,০০০ টাকা অর্থ আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ দিতে হয় বিধায় এসব এনজিও অঙ্গীকারবদ্ধ সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে না।

সভার কার্যবিবরণী সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
বছরের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো কোনো উপজেলা কমিটি সভা না করেই সভাপতিসহ সবার স্বাক্ষর নিয়ে সভার কার্যবিবরণী তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে আসা হয়।