বিদেশ থেকে সরকারবিরোধী অপপ্রচার বন্ধ হচ্ছে না কেন?

প্রায়ই দেখা যায়, কতিপয় ব্যক্তি-গোষ্ঠী বিদেশ থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি টিভি চ্যানেল ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে এসব অপপ্রচার চালানো হয়।

এইসব কনটেন্টের মধ্যে কিছু কন্টেন্ট সরানো হলেও ভাইরাল হয়ে যাওয়া অধিকাংশই প্ল্যাটফর্মগুলোয় থেকে যায়। দেশের সচেতন রাজনীতিক, প্রযুক্তিবিদ, সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে যারা কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে এসব অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।

সংসদ সদস্য এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে উজ্জ্বল। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। সরকারের এসব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সুপরিকল্পিতভাবে এখন বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। সরকারের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব এসব অপপ্রচার বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘একইসঙ্গে প্রকৃত ঘটনা জনগণকে জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন অপু বলেন, ‘যারা প্রবাসে বসে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করেন না। দেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করেন না। তারা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সব অপপ্রচারকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।’

ইকবাল হোসেন অপু বলেন, ‘জাতির পিতার কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নেওয়া বিভিন্ন মেগা প্রকল্প যখন বাস্তবায়নের প্রায় দোরগোড়ায়, তখনই সরকারের এগিয়ে চলার বিরুদ্ধে এই দেশীয় কিছু পাকিস্তানি দোসরদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সেইসব উন্নয়ন কাজ ব্যাহত করতে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। সরকারের উচিত এসব অপপ্রচার অবলিম্বে বন্ধ করতে হবে।’

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ তুহিন ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘সরকারের অগ্রগতির বিরুদ্ধে দেশীয় যেসব মানুষ বিদেশের মাটিতে বসে অপপ্রচার চালায়, আমরা তাদের আন্তর্জাতিক অপপ্রচারকারী হিসেবে গণ্য করি। যেমন, সাইবার ক্রিমিনাল তাসনিম খলিল, বিদেশে অবস্থানকারী ইলিয়াস হোসেন, কর্নেল (বরখাস্ত) শহীদ খান, প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারওয়ার, ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান, মেজর (বরখাস্ত) জিয়ার মতো মানুষগুলো বিদেশে বসে এই দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টা করছে।’

এসব অপপ্রচার সংবলিত পোস্ট বা কন্ট সরানো প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ব্যাকডোর প্রা.লি.- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর জোহা ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ২ ধরনের প্রযুক্তি আছে। একটা ওয়েব বেইজড, আরেকটা অ্যাপ বেইজড। ওয়েব বেইজড মানে হচ্ছে একটা ওয়েব পোর্টাল। যেটাকে আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করার সক্ষমতা আমাদের রাষ্ট্রের আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুকের একটা অংশ বন্ধ করা সম্ভব, সেটা শুধু যারা ফেসবুকের ডেস্কটপ বা ব্রাউজারে ব্যবহার করে তাদেরটা। কিন্তু যারা অ্যাপে ফেসবুক ব্যবহার করে তাদেরটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ, ফেসবুকের অ্যাপের ইন্টারনাল টেকনিক্যাল আর্টিকেচারে কিছু ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) সৃষ্টি হয়। এই ভিপিএনের আইপি আমাদের রাষ্ট্রীয় কারিগরি দিক যারা দেখেন, তারা নজরদারি করতে পারেন না। এটা ট্রেস করার সুযোগ নেই, তাই এটা দৃশ্যমান থাকে। এছাড়া এটা ডায়নামিক হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হয়। এই কারণে অ্যাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অ্যাপের কনটেন্টও সরানো সম্ভব হয় না।

জোহা বলেন, ‘আমাদের সর্বক্ষেত্রে আমাদের কনটেন্ট কন্ট্রোল করার সুযোগ নেই। তবে এই ফেসবুক-ইউটিউবের সঙ্গে যতক্ষণ না রাষ্ট্রের একটা কূটনৈতিক সম্পর্ক হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা এই কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না।’

এই প্রসঙ্গে সার্টিফায়েড কম্পিউটার ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর ইশরাত জাহান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়ে চাইলেই কিছু সিস্টেমেটিক সফটওয়ার দিয়ে এই তথ্য বা কনটেন্টগুলো মুছে দেওয়া সম্ভব। এ সংক্রান্ত একটা সফটওয়ার আছে, যা একটি ডেটা ধ্বংসকারী সফটওয়ার। এই সফটওয়ার দিয়ে সম্পূর্ণ ডেটা মুছে দেওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া আরও কিছু সফটওয়ার আছে। এগুলো খুব সহজে ও সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ডেটা ধ্বংস করে।’

এই বিষয়ে নিরাপত্তা সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিদেশ থেকে অনেকেই সরকারের ভালো কাজগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত তৈরি করছে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিক্ষিপ্তভাবে এসব তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের র‍্যাব সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে যেসব আইডি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিভ্রান্তমূলক তথ্য ছড়াচ্ছে, সেই আইডিগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু বিদেশ থেকে কেউ যদি এটা করে, তাহলে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা র‍্যাবের পক্ষে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। পুলিশের একটি সংস্থা আছে, যারা বিদেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। তাদের মাধ্যমে বিদেশে বসে যারা আমাদের দেশের বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে বিভ্রান্তমূলক তথ্য ছড়াচ্ছে, তাদের সম্পর্কে বিদেশি সংস্থাগুলোকে তথ্য পাঠানো হয়। এইভাবে একটা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যে সব অনলাইন সাইট ব্যবহার করে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রচার করা হয়, সেই সাইটগুলোকে আমরা শনাক্ত করে তালিকাভুক্ত করি। এরপর আমরা এই সাইটগুলো বন্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিউনিকেশনকে (বিটিআরসি) অভিযোগ দিয়ে থাকি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।’

খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘র‍্যাব সাইবার মনিটরিং সেল নিয়মিতই এই বিষয়গুলো মনিটরিংয়ের ওপর রাখে। আমরা যেটা করি, সেটা দেশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে কাজ করে থাকি। টেকনোলজির জন্য আলাদাভাবেই বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে, তবে আমরাও বাংলাদেশের ভেতর সাইবার ক্রাইম করে, বিভ্রান্তমূলক তথ্য ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, এই বিষয়গুলো আইডেন্টিফাই করে তাদের আটক-গ্রেফতার করি।’

বিদেশ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের সরকার প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই তাদের কাছে রিপোর্ট করে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি, যথাযথ সময়ের মধ্যে অপপ্রচার সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট সরানোর জন্য। তবে আমেরিকায় বসে ফেসবুক-ইউটিউব তাদের নিজেদের নীতিমালায় কাজ করে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো কনটেন্ট সরায়।’

সরকারের হাতে এগুলো নিয়ন্ত্রণের কোনো হাতিয়ার নেই উল্লেখ করে এই মন্ত্রী বলেন, ‘ফেসবুক-ইউটিউব থেকে কনটেন্ট সরানোর কোনো প্রযুক্তি আমাদের কাছে কেন সারাবিশ্বের কারও কাছে নেই। আমাদের কাছে ওয়েবসাইট বন্ধের প্রযুক্তি আছে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের কোনো ক্ষমতা নেই।’ তিনি আরও বলেন, তাই ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশ ফেসবুক-গুগলকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ভারতের মতো দেশ সোশ্যাল মিডিয়া আইন করেছে। কোন কোন দেশে তো ফেসবুক-গুগল সেসব দেশের মিডিয়ার সঙ্গেও রেভিনিউ শেয়ার করছে। তাই আমদেরও এখন এমন নীতিমালা করার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই আমি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে বলেছি, এমন কিছু করা যায় কি না।’

সংবাদ সূত্রঃ ইত্তেফাক অনলাইন