অটিস্টিকদের আপনজন

মোহাম্মদ ওমর ফারুক
একবার হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের সময় সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেছিলেন- মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করাই আমার দায়িত্ব’। তার ধারাবাহিকতা তিনি অব্যাহত রেখেছেন।

একসময়ে বাংলাদেশে অটিজম কি সেটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তখন মানুষ মনে করতো অটিজম একধরনের অভিশাপ। আর এখন সবাই বুঝতে শিখেছে অটিজম কি, কেন হয় বা কতটুকু সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়ে বাংলাদেশে প্রথম আওয়াজ তুলেন প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। জাতির জনকের এবং মায়ের মতো একটি সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন এই মানুষটি।

বাংলাদেশ প্রথম সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে ও প্রচেষ্টায় অটিস্টিকদের সেবা ও পুনর্বাসনে নিরলস কাজ করছে। তিনি ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুতুলকে হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। মনস্তত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত আছেন। পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করছে। তাঁর উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করছে। তাঁর উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে অটিজম সচেতনতা ও সেবা নিয়ে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে অটিজম বিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং কারিগরি নির্দেশক কমিটির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে অটিজম সচেতনতা, দ্রুত চিহ্নিতকরণ, সেবা ও পুনর্বাসনে কাজ চলছে। এজন্য ১৩টি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশে অটিজম সচেতনতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার ক্ষমতায়ন, নীতি ও আইনি কাঠামো চিহ্নিতকরণ, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও অভিভাবকের সমন্বয়, দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলা ও অধিকতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সামর্থ্য বাড়ানো, প্রচলিত জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণে অটিজমকে সম্পৃক্ত করা, দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও গবেষণা— এই সাতটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছয় স্তরে কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ চলছে, যেখানে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে।

কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, চিকিত্সক, সেবাদানকারী ও মা-বাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব ধরনের প্রতিবন্ধীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিত্সা দিতে দেশের ৬৪ জেলায় ১০৩টি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়ানোর অঙ্গীকার রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। এছাড়া অটিস্টিক শিশুকে মূলধারায় আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বিশেষ একাডেমি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। অটিস্টিকদের জন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের একাগ্রতার কারণে। এসব নিয়ে কাজ করে সারা বিশ্বে তিনি হয়েছেন সমাদৃত। পেয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশ্বে অটিজম ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশে অটিস্টিকদের জন্য কাজ করা খুব সহজ নয়। এর জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। এসব দেশে অটিজম মোকাবিলায় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সীমিত সেবা, সেবাদানকারীদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পুতুল। তবে এসব চ্যালেঞ্জ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে— বলেও মন্তব্য করেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য সায়মা। অটিজম আক্রান্ত শিশুরাও এই সমাজের অংশ এবং তাদেরও সব পর্যায়ে সমান অধিকার থাকার বিষয়টি যত বেশিসংখ্যক মানুষ বুঝতে পারছেন, সমস্যাটি ততই হালকা হয়ে আসছে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন একদিন বাংলাদেশ আরো সুন্দর হবে সারা বিশ্বে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ

Leave a Comment