ডাক্তার এবং নার্সদের নির্দয় আচরণ, অন্য রোগীদের সেবা ব্যাহত

ঠান্ডা-কাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের উপসর্গও এগুলো। ফলে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কেউ হাসপাতালে আসলেই চিকিৎসক-নার্সদের অনেকেই রোগীদের সেবা দিতে চাচ্ছেন না। ডাক্তার এবং নার্সদের নির্দয় আচরণের ফলে, অনেক রোগী এক সপ্তাহ ধরে সেবা নিতে পারছেন না। জ্বর থাকলেই ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো। বেশির ভাগ ডাক্তার সর্দি-কাশি-জ্বর ও গলা ব্যথা আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সা দেবেন না বলেও লিখে রেখেছেন। এই পরিস্থিতিতে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সংকটে প্রাণহানির ঘটনা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বর, সর্দি-কাশির রোগীদের চিকিত্সার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে জ্বর, কাশিতে আক্রান্তরা এসব হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গিয়েও পড়ছেন বিপাকে। করোনা-আক্রান্ত সন্দেহে চিকিত্সকরা দূর থেকেই এসব রোগীকে চিকিত্সা দিচ্ছেন। রোগীদের রয়েছে অবহেলার অভিযোগ। বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের কারণে জ্বর বা শ্বাসকষ্ট অনুভব হওয়া রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালেও চিকিত্সকরা ঠান্ডা-সর্দি-জ্বর-কাশি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের স্পর্শ পর্যন্ত করছেন না। কাউকে কাউকে আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বর দেখিয়ে বিদায় করা হচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৩ মার্চ নাজমা আমিন নামে কানাডাপ্রবাসী এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেবাদানের একপর্যায়ে সেবা-সংশ্লিষ্টরা তার করোনাভাইরাস সন্দেহে আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসকরা রোগীর ওয়ার্ড থেকে বেড় হয়ে যান। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও আইসিইউ সাপোর্টের অভাবে মারা যান ওই তরুণী।

এ ছাড়া গত শুক্রবার জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন মধ্যপ্রাচ্য (বাহরাইন) ফেরত এক প্রবাসী। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তার দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ দেখতে পান চিকিৎসকরা। এতে সাত নম্বর পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা অন্যান্য রোগীসহ দায়িত্বরত চিকিৎসক-নার্সরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই রোগীকে কোথায় রাখা হবে। চিকিৎসা কীভাবে শুরু হবে- এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে ওই রোগী ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, বিষয়টি জেনেছি, বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ডাক্তাররা যাতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু রাখেন সে ব্যাপারেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চিকিত্সকরা অভিযোগ করে বলেন, করোনা ভাইরাস সন্দেহভাজন রোগীদের সেবাদানে হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয়সংখ্যক নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন—পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, অ্যাপ্রোন, বিশেষ গাউন, সার্জিক্যাল মাস্ক, চশমা ও জীবাণুমুক্তকরণ রাসায়নিক উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে, রোগীদের জন্য মানসম্মত কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন অবকাঠামো না থাকায় সংক্রমণ ঝুঁকি রয়েছে। ঠান্ডা-কাশি ও শ্বাসকষ্ট করোনার উপসর্গও হতে পারে। তাই তারা রোগী সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন বলে যুক্তি তুলে ধরেন।

রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এম শামীম জানান, প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকে ১ লক্ষ বেড আছে। আমরা সরকারকে এখন থেকে তিন মাস সহযোগিতা করতে পারি। তবে আমাদের গার্মেন্টসের মতো আর্থিক সহযোগিতা দিলে রোগীদের চিকিত্সাসেবা দিতে পারব এবং এতে অন্য রোগীরা উপকৃত হবেন। আমি আমার হাসপাতালের ১০০ বেড তিন মাসের জন্য ছেড়ে দেব করোনা রোগীদের চিকিত্সাসেবা দেওয়ার জন্য।

বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিকরা বলেন, ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা কেন ঝুঁকি নেবে? সবার আগে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে ২ লাখ পিপিই বেসরকারি হাসপাতালে দেওয়া হলে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া ডাক্তার-নার্সসহ সেবাকর্মীদের ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করা উচিত। এসব নানা কারণে অনেকে ডিউটি করতে চান না। আগে ব্যবস্থাপনা জরুরি।

সরেজমিনে রাজধানীর এবং দেশের জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিত্সকরা রোগীদের সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট এলাকার শফিকুর নাহার। ৬৫ বছরের এই বৃদ্ধার সম্প্রতি হঠাত্ করে কানের সমস্যা হয়। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যা থেকে ডাক্তার দেখাতে ছুটে বেড়িয়েছেন তিন-চারটি ডাক্তারের চেম্বার। কোথাও ডাক্তার পাননি।

একইভাবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে বাড়িতে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে আছেন। সামান্য রোগব্যাধির কারণে তাদেরও চিকিৎসাসেবা পেতে রীতিমতো ঘাম ঝড়াতে হচ্ছে। কারণ, তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের তাপমাত্রা পরীক্ষা পর্যন্ত করতে ভয় পাচ্ছেন।