প্রধান বিচারপতির বিবৃতি নিয়ে যা বলল আ’লীগ

দেশ ছাড়ার অন্তিম মহুর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে গাড়িত ওঠার আগে বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এক লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতির এ বিবৃতি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক।

তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যাওয়ার আগে যে লিখিত বক্তব্য দিয়ে গেছেন, তাতে স্পষ্ট হয়েছে, তার এই বক্তব্য অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা হতাশাজনক বক্তব্য। তার এই বক্তব্য অস্থিরতা তৈরি করবে।’ আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার ছুটির আবেদনে লিখেছেন, তিনি অসুস্থ। এখন তার মুখে এই বক্তব্য শোভা পায় না।’

আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকে শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন। সেখানে তিনি অসুস্থতার কথা বলেছেন। কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যে অসুস্থ, তার প্রমাণিত হয়, তিনি আইসিডিডিআরবিতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। তিনি তার লিখিত আবেদনেই বলেছেন, তিনি অসুস্থ। তার ছুটি চাওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনও চাপ ছিল না।’

উল্লেখ্য, শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৭ ফ্লাইটে দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। এর আগে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে ঢাকার হেয়ার রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দরের পথে গাড়িত ওঠার আগে বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান বিচারপতি সিনহা। এসময় তিনি এক লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানিং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে আলোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ, গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমিয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এরদ্বারা বিচারবিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।”

এদিকে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে দেখা করতে শুক্রবার তার বাসায় যান স্বজনরা। শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যান তারা। স্বজনদের মধ্যে ছিলেন প্রধান বিচারপতির ভাই এন কে সিনহা, ভাতিজি জামাই রাজমন সিনহা, সুজিত সিনহা ও রাম কান্ত সিনহা ও শ্যালিকা শিলা সিনহা।

সকাল ১০টা ২২ মিনিটে প্রবেশ করেন ভাতিজি জামাই সুজিত সিনহা ও রাম কান্ত সিনহা, ১০টা ২৩ মিনিটে বাসভবনে প্রবেশ করেন শিলা সিনহা, ১২টা ৪৫ মিনিটে প্রবেশ করেন ভাতিজি জামাই রাজমন সিনহা। প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই উচ্চ পর্যায়ের লোকজন ও স্বজনরা তার বাসায় যাচ্ছেন। গত সপ্তাহেও তার বেয়াই-বেয়াইন, ভাইসহ স্বজনরা দেখা করতে প্রধান বিচারপতির বাসায় গেছেন।

প্রসঙ্গত, গত ২ অক্টোবর একমাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে চান বলেও রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছেন। শুক্রবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের ফ্লাইটে প্রধান বিচারপতির জন্য টিকিট কাটা হয়।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ইসমাইল হোসেন দেখা করতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে প্রবেশ করেন। এর পরে সন্ধ্যা ৬টা ১৭ মিনিটে ওই বাসায় প্রবেশ করেন প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত সহকারী আনিসুর রহমান।

বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির ছুটি সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করে। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক স্বাক্ষরিত এই আদেশে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির আবেদনে এর আগে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেহেতু আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি নতুন আদেশ দিয়েছেন।’

উল্লেখ্য, ২৫ দিনের অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিনই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১ নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ছুটিতে যান সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ নিয়ে রাজনৈতিকমহল ও আইনজীবীদের মধ্যে আলোচনার ঝড় ওঠে। এর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় এবং বিচারিক আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত গেজেট নিয়ে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির মত পার্থক্য দেখা দেওয়ায়, প্রধান বিচারপতিকে জোর করে ছুটিতে পাঠানোর অভিযোগ তোলে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা। তবে সরকার ও আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

প্রধান বিচারপতি বা আদালতের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর মধ্যেই প্রধান বিচারপতি সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় যেতে পাঁচ বছরের ভিসার জন্য দূতাবাসে আবেদন করেন। দেশটিতে বর্তমানে তাদের বড় মেয়ে সূচনা সিনহা অবস্থান করছেন। তাদের তিন বছরের ভিসা দেয় অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, ১৪ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ