ঢাবির মাস্টারপ্ল্যানে বদলে যাচ্ছে পুরো শহীদ মিনার এলাকা

পুরো শহীদ মিনার এলাকা বদলে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল বেদি ঠিক রেখে পুরো এলাকা সাজছে নতুন আঙ্গিকে।

পাশে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন, সড়ক, দুই পাশের চত্বর, গাড়ি চলাচলের গতিবিধি- প্রভৃতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন। নতুন প্ল্যানে শহীদ মিনারের মূল বেদির পেছনে থাকবে গাছের বেষ্টনী। আর দুই পাশে দু’টি সবুজ চত্বর। সামনের দিকে থাকবে আরো চারটি চত্বর। এর পরে ঢাকা মেডিক্যালের দিক থেকে যে সড়কটি শিববাড়ির দিকে গেছে তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। একইসঙ্গে শহীদ মিনার থেকে পলাশীর দিকে যাওয়া রাস্তাও থাকবে বন্ধ। এ দু’টি শহীদ মিনারের ব্যক্তিগত সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কোন ধরনের যান চলাচল থাকবে না। টিএসসি থেকে যেতে জগন্নাথ হল আর শিববাড়ির রাস্তার মাঝখানে থাকা শিক্ষকদের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার ভবনগুলো ভেঙে ফেলা হবে। সেখানে সবুজের মিশেলে থাকবে দৃষ্টিনন্দন চত্বর।

এভাবেই বদলে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা।

সম্প্রতি শতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেওয়া মাস্টারপ্ল্যানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশকে এভাবে দৃষ্টিনন্দন ও বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো প্ল্যানটি দেখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।

মাস্টারপ্ল্যান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সরকার ঘোষিত ষোলটি ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অন্যতম। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বাঙালির অমর স্মৃতি। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে অতিদ্রুত ও অপরিকল্পতভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীসময়ে শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। যার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় শহীদ মিনার এলাকার পরিবেশ ঘিঞ্জি হয়ে ওঠে। রাতে মাদকসেবী ও ভবঘুরেদের আস্তানায় পরিণত হয়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রণীত হওয়া মাস্টারপ্ল্যানে শহীদ মিনার এলাকাকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনায় যেমন যানজটের ভোগান্তি কমবে, তেমনি বজায় থাকবে শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্য।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে শহীদ মিনার এলাকার সড়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ব্যস্তময় এলাকার একটি হয়ে ওঠে। যে কারণে সারাক্ষণ লেগে থাকে যানজট। শহীদ মিনারে আসা দর্শনার্থীদের রাস্তা পারাপারে বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে জগন্নাথ হল আর ঢাবি মেডিক্যাল কলেজের মাঝখানে থাকা শিক্ষকদের আবাসিক ভবনগুলোর (৩৪, ৫০, ৫১ ও ৫২) কারণে রাস্তা পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেকে এটিকে বিষফোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত করেন। এছাড়া পেছনের দিকে মাজার ও ঢাকা মেডিক্যালের বহির্বিভাগের সামনে দোকানগুলোর কারণে অপরিষ্কার দেখা যায়।

মাস্টারপ্ল্যানে থাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার ডিজাইন বিশ্লেষণে দেখা যায়, কড়াকড়ি না থাকায় অনেক সময় দর্শনার্থী জুতা পায়ে মূল বেদিতে চলে যাওয়া, অনুষ্ঠান বা কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু নতুন পরিকল্পনায় মূল বেদি সম্পূর্ণভাবে সীমাবদ্ধ থাকায় পবিত্র পরিবেশ বিরাজ করার মতো অবস্থা থাকবে। মূল বেদির বিপরীতে করা চত্বরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশিষ্টজনদের মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা নিবেদন ও গল্প বা আড্ডার জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করা হবে। ভবনগুলোর বিপরীতে থাকা বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের পাশের পুকুরটিকে দৃষ্টিনন্দন লেকে পরিণত করা হবে। যার মধ্যে থাকবে ঝরনা। আইন অনুষদের জন্য প্রস্তাবিত নতুন ভবনের দেওয়ালে থাকবে ডিজিটাল স্ক্রিন।

শিক্ষকদের ভবনগুলো সরানোর কারণে উন্মুক্ত জায়গা বাড়বে। যেখানে বসা বা গল্প করার একটা পরিবেশ পাবে। বর্তমানে টিএসসির উপর যে চাপ থাকে সেটি অনেকাংশে কমে আসবে। গ্রিন এনভায়রনমেন্ট থাকবে। অন্যদিকে টিএসসি থেকে গাড়িগুলো সোজা রাস্তায় শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের দিকে রাস্তা দিয়ে বের হবে। বর্তমান দোয়েল চত্বর বা চাঁনখারপুল থেকে আসা গাড়িগুলো আর শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে আসতে পারবে না। তবে রাষ্ট্রীয় বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এই রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলমান। বর্তমানে এটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায়। এটি বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। মাস্টারপ্ল্যানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের স্মরণে নির্মিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অনেকেই শহীদ হলে দ্রুত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা নির্মাণ করেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা ছিল প্রথম শহীদ মিনার। ১০ ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া ছিল সেটি। নকশা করেছিলেন বদরুল আলম, সঙ্গে ছিলেন সাঈদ হায়দার।

শহীদ মিনার তৈরির কাজ তদারকি করেন জিএস শরফুদ্দিন। দু’জন রাজমিস্ত্রির সাহায্যে মিনারটি নির্মাণ করেন তারা। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ভাষাশহীদ শফিউরের বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে এই শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন। কিন্তু সেদিনই পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। পরে ঢাকা কলেজের সামনে আবার একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। স্থপতি ছিলেন হামিদুর রহমান। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন।