আমাকে কি সবাই ভুলে গেছো তোমরা: মুক্তামনি

কেবিনের দরোজা ঠেলে ঢুকতেই প্রশ্ন এলো, ‘এতদিন পর এসছো, আমাকে কি সবাই ভুলে গেছো তোমরা?’ কেউ তোমাকে ভোলেনি বলে তার বেডের পাশের চেয়ারে বসতেই স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে ওঠে মুক্তামনির মুখ।

অভিযোগের সুরে সে বলে, ‘শেষ (তৃতীয়) অপারেশনের পর তো আর তোমরা কেউ আসছো না। আগে এখানে কত মানুষ আসতো। কত সাংবাদিক আসতো, কিন্তু এখন তোমরা কেউ আসছো না।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ছয়তলার মুক্তামনির কেবিনে গেলে এমনই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিবেদককে। এসময় মুক্তামনির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো তার জমজ বোন হীরামনি। পাশ থেকে মুক্তামনির মা আসমা খাতুন বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই মুক্তা এসব কথা বলছিল। তাকে কেউ আর দেখতে আসছে না,কেউ আর তাকে আগের মতো ভালোবাসে না। সবাই ব্যস্ত আছে,সময় হলেই দেখতে আসবে বলে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছি আমরা।’

মুক্তামনির খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, গত মঙ্গলবারে (১৯ সেপ্টেম্বর) তার ড্রেসিং হয়েছে। আজ শনিবার আবার তার ড্রেসিং হবে।

ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানালেন, আগামী সপ্তাহ নাগাদ মুক্তামনির আরেকটি অপারেশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। মুক্তামনি যদি সুস্থ থাকে তাহলে তারা অপারেশন করবেন।

মুক্তামনি তখন ঘুমিয়ে ছিল। এসময় কথা হয় তার মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবারে ড্রেসিং করার সময়ে মুক্তা তার হাতের কিছুটা অংশ দেখতে পেয়েছিল। হাতটা স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে তার আনন্দ সীমাহীন। মেয়েটা জীবনে তো কিছুই পায়নি। ওর জমজ বোনটা সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়,স্কুলে যায়,ছোট ভাইটাকে আদর করে। কিন্তু সে তো কিছুই পারেনি,দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তাকে শুয়ে বসে কাটাতে হয়। কাউকে বলতো না,কেবল আমার সঙ্গে তার কষ্টের কথা বলতো। বলতো, একসঙ্গে আমরা দুই বোন, কিন্তু আমি কেবল শুয়ে থাকি। আমিতো ভাইকে একটু কোলে নিতেও পারি না-এসব কথা বলে কেবলই কান্না করতো মেয়েটা।’

আসমা খাতুন বলেন, ‘আমার মেয়েটা এখন সুস্থ হওয়ার পথে। আমি চাই মেয়েটা ঘর ভরে হাঁটুক, পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াক, আবার আগের মতো স্কুলে যাক, ভাইকে কোলে নিক।’

এরই মধ্যে জেগে ওঠে মুক্তামনি। সুস্থ হওয়ার পর প্রথমে কী করবে জানতে চাইলে মুক্তামনির উত্তর, ‘হাত ভালো হওয়ার পর প্রথমে ছোট ভাইটাকে কোলে নেবো, তাকে আদর করবো।’

জমজ দুই মেয়ের মধ্যে মুক্তামনি আধাঘণ্টার ছোট। আসমা খাতুন বলেন, ‘জন্ম থেকেই মুক্তা দুর্বল প্রকৃতির। ওর জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি ছোটটা মনে হয় বাঁচবে না। কিন্তু সেই মেয়ে আমার বেঁচে উঠেছে। সেটা বাঁচার মতো বাঁচা হয়নি। সেসব দিনের শেষ বোধ হয় এবারে হতে চলেছে। মেয়েটা আমার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে আর তার পছন্দের ভাত-গোস্ত খাবে।’

ভাত আর গরুর মাংস মুক্তার পছন্দের খাবার। ডিম খেতো পছন্দ করতো জানিয়ে তার মা বলেন,‘ডাক্তারের নির্দেশে হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন তাকে চারটা করে ডিম খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আর সে ডিম খেতে চায় না। একনাগাড়ে আর কত খেতে পারে একই জিনিস?’

মুক্তামনির বোন হীরামনি প্রতিটি মুহূর্তে বোনের পাশে থাকছে। বোনের যে কোনও কাজ করে যাচ্ছে হাসিমুখে। বোনকে পানি খাওয়ানে,চুল আচড়ানো,খাবার খাওয়ানোসহ ব্যক্তিগত সব কাজে বোনকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে ক্লান্তিহীনভাবে। মুক্তামনির জন্য কষ্ট লাগে কিনা জানতে চাইলে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কেঁদে দিয়ে বলে, ‘ওর জন্য আমার বুকের ভেতরে কেমন যে করে সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমি সবকিছু করি, কিন্তু বোনটা আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল ব্যথায় কষ্ট পায়। মাঝে মাঝে মনে হয়,ওর কষ্টটা যদি ভাগ করে নিতে পারতাম তাহলে কিছুটা হলেও ওর কষ্ট কমতো।’ সূত্র:বাংলা ট্রিবিউন

বাংলাদেশ সময় : ১১৫২ ঘণ্টা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ